হযরত খুবাইব ইবনে আদি (রা.)

 





মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার যখন বেড়েই চলেছিল তখন আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে নবীজী (সাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। দুনিয়া থেকে ইসলামকে চিরতরে মুছে দিতে মক্কার মুশরিকরা সব ধরনের পরিকল্পনা করেও ব্যর্থ হয়। তাদের এ প্রচেষ্টা হিজরতের পরেও চলমান ছিল। দ্বিতীয় হিজরীতে ইতিহাসের এক নজিরবিহীন অসম যুদ্ধের অবতারণা হয় বদরের প্রান্তরে। গুটিকয়েক মুসলমানদের একটি বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয় মুশরিকদের বিশাল বাহিনী।

উহুদের যুদ্ধেও তেমন সুবিধা করতে না পেরে এবার তারা চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম মক্কার উপকণ্ঠে একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করলেন মুশরিকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম দশ বা বরোজনেরজনের একটি দল অনুসন্ধানের জন্য তৈরি করলেন। তাদের নেতৃত্বের ভার অর্পিত হয় আসেম ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর উপর। তাদের মধ্যেই একজন খুবাইব ইবনে আদি রাদিয়াল্লাহু আনহু।
তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং মক্কার উপকণ্ঠে রাজি নামক একটি ঝর্ণার কাছে পৌঁছানো। এমন সময়ই কিছু লোক তাদের দেখে ফেলে এবং গোপনে হুজাইন গোত্রের একটি শাখা বনু লেহিয়ান এর লোকদের জানিয়ে দেয়। বনু লেহিয়ান এর লোকেরা খবরটি জানতে পেরে শতাধিক তীরন্দাজের একটি দক্ষ বাহিনী তৈরি করে তাদের আক্রমণের জন্য লেলিয়ে দেয়। তীরন্দাজের সেই দলটি সাহাবীদেরকে খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় হঠাৎ করেই তাদের একজন পথের পাশে একটি খেজুরের আটি দেখতে পায়। আটিটি পর্যবেক্ষণ করে এসে সে বলে, এটি অবশ্যই মদিনার খেজুর আটি। এটি ছিল আরবদের আশ্চর্য এক বৈশিষ্ট্য তারা আটি দেখেই বলে দিতে পারতো কোন অঞ্চলের খেজুর এটা। আসেম ইবনে সাবেত রাদিআল্লাহু আনহু বুঝতে পারলেন তাদের কেউ অনুসরণ করছে তাই তিনি তার সাথীদের নিয়ে একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
এক পর্যায়ে তীরন্দাজ দলটি তাদের ঘিরে ফেলে এবং অবরোধ করে। তাদেরকে হত্যা না করার শর্তে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানায়। কিন্তু আছেম ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু অঙ্গীকার করলেন তিনি মুশরিকদের আশ্রয় গ্রহণ করবেন না। দলপতির নির্দেশে সাথীরা সিংহের মতো লড়াই করে মুশরিকদের সাথে। হামলা-পাল্টা হামলা শা-শা করে তীর ছুটে চলছে এদিক থেকে ওদিক। মাত্র দশ জনের ছোট দলটি বীরদর্পে লড়ে যায় একশত জনের বিশাল বাহিনীর সাথে। হঠাৎ এই একটি তীর উড়ে আসে আর বিদ্ধ হয় আসেম ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বুকে। লুটিয়ে পড়েন সাহাবী আসেম ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু। একে একে শহীদ হন সাত জন সাহাবী। বাকি আছেন মাত্র ৩ জন সাহাবী, খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ ইবনে তারিক এবং যায়েদ ইবনে দাসিনা রাদিয়াল্লাহু আনহু। মাত্র তিনজনেই বীরদর্পে লড়ে যান বিশাল এই বাহিনীর বিপক্ষে।
সাহাবীদের ক্ষুদ্র এই তিনজনের দলের সাথে মুশরিক বাহিনীটি পেরে না উঠে এবার তাদের হত্যা না করার শর্তে আত্মসমর্পণ করার আহবান করে। কোন উপায় না পেয়ে সাহাবীরা পাহাড় থেকে নেমে আসেন কিন্তু মুশরিকরা তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে। নিরস্ত্র সাহাবীদেরকে তারা শক্ত করে বেঁধে ফেলে মক্কায় বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে মাররুজ জাহারানে আব্দুল্লাহ ইবনে তারিক রাদিয়াল্লাহ আনহু হাতের বাধন খুলে ফেলেন এবং মুশরিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। লড়াই করতে করতে তিনি এক পর্যায়ে শহীদ হন।
হযরত যায়েদ ইবনে দাসিনা (রা) কে সফওয়ান ইবনে উমাইয়া পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে কিনে নেয়। আর খুবাইব (রা) কিনে নেয় হারিস এর সন্তানরা। বন্দী অবস্থায় হযরত খুবাইব ইবনে আদি রাদিআল্লাহু আনহু একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হন। তার সেই ছোট্ট বন্দি জীবনে অনেক শিক্ষা রয়েছে আমাদের জন্য।
খুবাইব -কে মক্কা থেকে বের করা হচ্ছে। মক্কার উপকণ্ঠে জনসমুদ্রের সামনে তাঁকে হত্যা করা হবে। তখন খুবাইব (রাঃ) তাদের বললেন, আমাকে দু’ রাকাআত সালাত (নামাজ) আদায় করতে দাও। তারা তাঁকে সে অনুমতি দান করল। তিনি দু’ রাকাআত সালাত আদায় করে নিলেন।তারপর তিনি বললেন, ’তোমরা যদি ধারণা না করতে যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছি তবে আমি সালাত কে দীর্ঘায়িত করতাম।এবার তাঁকে হত্যা করার পালা। চারপাশে অনেক মানুষ আগে থেকেই অস্ত্র হাতে প্রস্ত্তত হয়েছিল। এবার তারা তার উপর আঘাত শুরু করল। তবে তা একবারে নয়। তলোয়ার বর্শা ও বিভিন্ন অস্ত্রের ফলা দিয়ে হযরত খুবাইবের জীবিত দেহ থেকে একটার পর একটা গোশতের টুকরা কেটে নিতে লাগল। উহ! কী যে মর্মান্তিক আর কী যে নিষ্ঠুর সে দৃশ্য! প্রতিটি আয়াতের সাথে সাথে দরদর করে তাজা রক্তের ধারা বয়ে চলেছে...। হযরত খুবাইব যন্ত্রণায় ছটফট করছেন...।
পাষাণ হৃদয় কাফেরদের মনে তবুও একটু দয়ার সঞ্চার হচ্ছে না। এ নিমর্ম দৃশ্য দেখে বরং তারা নাচছে গাইছে ও আনন্দ করছে। তাদের নিষ্ঠুর মনে খুশীর ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।
আঘাতে আঘাতে হযরত খুবাইব ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ছিলেন। শরীর থেকে বয়ে চলছিল অবিরাম রক্তের ধারা।
তাঁকে বলা হলাে-'আচ্ছা তুমি কি চাও তােমার জায়গায় মুহাম্মাদ -কে আনা হােক; আমরা তাঁকে হত্যা করব, তাঁর পরিবর্তে তুমি পরিবার-পরিজনের সাথে নিরাপদে থাকো? তিনি বললেন, খােদার কসম! আমি ঘরে নিরাপদে বসে থাকি আর তার বিনিময়ে মুহাম্মাদ -এর গায়ে একটা কাঁটাও বিদ্ধ হােক, তা-ও আমি চাই না। অর্থাৎ 'নবিজির পায়ে একটা কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার চেয়ে আমার কাছে মৃত্যু অধিক প্রিয়। এই হলাে আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং নবিজির প্রতি অকুষ্ঠ ভালােবাসার বহিঃপ্রকাশ। এরপর অমর নবীপ্রেমিক হযরত খুবাইব শহীদ হয়ে গেলেন। তাঁর দেহ নিথর হয়ে গেল। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি নবীপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেলেন।
ওমর (রাঃ)-এর গভর্ণর সাঈদ বিন ‘আমের (রাঃ) যিনি খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হবার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল