খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল



#মো. আবু রায়হান
ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসলাম পূর্বের চেয়ে আরো বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠে।
খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। যেহেতু এ যুদ্ধে অনেক পরিখা খনন করা হয়, তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী।হযরত সালমান ফারসি এরূপ পরিখা খননের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কুরাইশদের সাথে বনু নাজির ও বনু কাইনুকা জোট গঠন করে মদিনা আক্রমণ করেছিল। ইতিপূর্বে বনু নাজির ও বনু কাইনুকা গোত্রকে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাই প্রতিশোধ হিসেবে তারা কুরাইশদের সাথে জোট গঠন করে।৬২৭ সালের শুরুর দিকে বনু নাজির ও বনু ওয়াইরের ইহুদীদের একটি সম্মিলিত প্রতিনিধি দল মক্কা গিয়ে কুরাইশদেরকে মদীনার ওপর হামলা চালিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আহ্বান জানায় এবং এ কাজে তাদের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এই দলের মধ্যে উল্লোখযোগ্য লোক ছিল বনু নাযীর গোত্রের সালাম ইবনে আবুল হুকাইক, হুয়াই ইবনে আখতাব, কিনানা ইবনে আবুল হুকাইক এবং ওয়াইল গোত্রের হাওয়া ইবনে কায়েস ও আবু আম্মার। তারা যুক্তি দেখায় যে কুরাইশরা মুসলিমদেরকে উহুদের পর পুনরায় বদরে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পালন করতে না পারায় যোদ্ধা হিসেবে কুরাইশদের সম্মান নষ্ট হয়েছে। কুরাইশরা তাদের প্রস্তাব মেনে নেয়।তারা আরবের বহু সংখ্যক গোত্রকে ঐক্যবদ্ধ করে রাসূলুল্লাহ (সা) এর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে প্ররোচিত করে।বনু গাতাফান গোত্রের কাছে গিয়ে তাদেরকেও যুদ্ধের জন্য রাজি করায়। পাশাপাশি তারা অন্যান্য গোত্রগুলির কাছে গিয়েও যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কা থেকে ১০ হাজার লোকের সম্মিলিত বাহিনী মদিনার দিকে যাত্রা করে। সেসঙ্গে তাদের ৬০০ ঘোড়া ও কিছু উট ছিল।মক্কার সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধযাত্রার খবর পেয়ে নবীজি(সা.) সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শ করলেন। মদিনার তিন দিকে খেজুরগাছের বাগান। বাকি থাকে একদিক।(সালা পাহাড়কে পেছনে এবং ওহুদ পাহাড়কে সামনে রেখে পরিখা খনন হয়) সেদিকে পরিখা খননের কথা হযরত সালমান ফারসি(রা.) বললেন।পরিখা খনন ছিল পারস্য দেশের একটি যুদ্ধকৌশল। একটি ঘোড়া লাফ দিয়ে যতটুকু যেতে পারে, তার চেয়ে বেশি দূরত্বে গর্ত খনন করা হয়। তাই শুরু হলো পরিখা খনন। ১০ জন করে একটি গ্রুপ। প্রতিটি গ্রুপ দৈর্ঘ্য ১০ হাত, প্রস্থে ১০ হাত, গভীরতায় ১০ হাত পরিখা খনন করে। ছয় দিনে পরিখা খনন শেষ হয়। পরিখা খননকালে একটি বড় ও শক্ত পাথর সামনে পড়ে, যা ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাসুল (সা.)–কে বিষয়টি জানানো হলে তিনি এসে আঘাত করলে তা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।সাহাবী বারা বিন ‘আযেব (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে খন্দকের মাটি বহনরত অবস্থায় দেখেছি। যাতে তাঁর সারা দেহ বিশেষ করে পেটের চামড়া ধূলি-ধূসরিত হয়ে গিয়েছিল’ (বুখারী হা/৪১০৪)।হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, খননকালে একটি বড় ও শক্ত পাথর সামনে পড়ে। যা ভাঙ্গা অসম্ভব হয়। রাসূল (সা)-কে বিষয়টি জানানো হ’লে তিনি এসে তাতে কোদাল দিয়ে আঘাত করলেন, যাতে তা ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে বালুর স্তূপের ন্যায় হয়ে গেল, যা হাতে ধরা যায় না। অথচ ঐসময় ক্ষুধার্ত রাসূল (সা)-এর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। আমরাও তিনদিন যাবৎ অভুক্ত ছিলাম’ (বুখারী হা/৪১০১)। এ ঘটনা নবী করিম (সা.)-এর একটা বিশেষ মুজিজা।রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ক্ষুধার ব্যাপারটি অবগত হয়ে সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী এক ছা‘ (আড়াই কেজি) যব পিষে আটা তৈরী করলেন। অতঃপর রান্না শেষে রাসূল (সা)-কে কয়েকজন সাহাবী সহ গোপনে দাওয়াত দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তখন ঐ সময় পরিখা খননরত ১০০০ সাহাবীর সবাইকে সাথে নিয়ে এলেন। অতঃপর সকলে তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পরেও আগের পরিমাণ আটা ও গোশত অবশিষ্ট রয়ে গেল।সম্মিলিত বাহিনী যখন মদিনায় এসে উপনীত হয়, তখন সাহাবিদের খননকাজ শেষ। ১০ হাজার সেনার বাহিনী ওহুদ পাহাড়ের পাশে তাঁবু ফেলে। নবীজি হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৩ হাজার সাহাবি নিয়ে হাজির হলেন। দুই দল দুই দিকে, মাঝখানে খন্দক। কুরাইশ বাহিনী খন্দক দেখে হতভম্ব।

মদিনা অবরোধ
এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলো মদিনা অবরোধ করে রাখে জোট বাহিনীর । এই অবরোধ এত কঠিন ছিল যে মুসলমানদের বহু বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। কিন্তু অবরোধকারীরা কিছুতেই পরিখা পার হতে পারল না।হযরত মুহাম্মদ(সা.) তাঁর সৈন্যদের পরিখার বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করলেন। কাফেররা বাইরে থেকে পাথর ও তির ছুড়তে শুরু করলে এদিক থেকেও তার প্রত্যুত্তর দেওয়া হলো। এরই ভেতর বিক্ষিপ্তভাবে দু-একটি হামলাও চলতে লাগল। অবরোধ যত দীর্ঘায়িত হলো, শত্রুদের উৎসাহও তত কমতে লাগল। ১০ হাজার লোকের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তার ওপর ছিল প্রচণ্ড শীত। এরই মধ্যে একদিন এমন প্রচণ্ড বেগে ঝড় বইল যে কাফেরদের সব ছাউনি উড়ে গেল। তাদের সৈন্যসামন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের ওপর যেন আল্লাহর আজাব নেমে এল। আর বাস্তবিকই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য রহমত এবং কাফেরদের জন্য আজাব হিসেবেই এ ঝড় পাঠিয়েছিলেন। কাফেররা এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারল না। অবস্থা বেগতিক দেখে ইহুদিরা আগেই সরে পড়েছিল। কুরাইশদেরও ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
আহজাব যুদ্ধে ৮ জন মুসলিম শহীদ হন। অন্যদিকে, শত্রুপক্ষে ৪ জন মারা যায়। অবরোধের সময় কেউ বলেছেন ২৪ দিন, অন্য বর্ণনায় ১৫ দিন পাওয়া যায়। খন্দক যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন, যাতে এই যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। খন্দক আমাদের এই শিক্ষা দেয়—ইমান ও ধৈর্যের সঙ্গে আল্লাহর ওপর আস্থা স্থাপন করলে আল্লাহর রহমত থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ