কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)।ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি এ কাবাকে কেন্দ্র করেই। হাদিসের ভাষ্য মতে, কাবার নিচের অংশটুকু পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে এর সৃষ্টি। ধীরে ধীরে এর চারপাশ ভরাট হতে থাকে। সৃষ্টি হয় একটি বিশাল মহাদেশের। এক মহাদেশ থেকেই সৃষ্টি হয় সাত মহাদেশের।আল্লামা ইদ্রিস কান্ধলবী (র.)বলেন, নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল, চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি সৃষ্টি করার আগে মহান রাব্বুল আলামিন কাবার জমিন সৃষ্টি করেছেন।পরে কাবার নিচ থেকে জমিনকে বিস্তৃত করে সারা পৃথিবী সৃষ্টি করেন।তাফসিরবিদ মুজাহিদ বলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বায়তুল্লার স্থানকে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার বছর আগে সৃষ্টি করেন।রইসুল মুফাসসিরিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহর আরশ পানির উপরে বিদ্যমান ছিল।ইমাম বাগবী (রহ.) বলেন, জগত সৃষ্টির ২ হাজার বৎসর পূর্বে আল্লাহ এক ঘুর্নিঝড় প্রেরণ করলেন যা এ পানিকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিল আর এতে কাবা গৃহের অবস্থান স্থলে (বর্তমানে যেখানে কাবা অবস্থিত) গম্বুজের মতো একটি ফেনার সৃষ্টি হলো। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা এর নিচে মাটির পৃথিবীর বিস্তৃতি দেন আর তাতে পর্বতমালা সৃষ্টি করে এতে স্থিতি দান করেন। পৃথিবীকে স্থিতি দানকারী পর্বতের মধ্যে প্রথম পর্বত ছিল আবু কুবাইস নামক পর্বতটি। এ কারণেই মক্কাকে উম্মুল কুরা বা মূল জনপদ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
এক কথায় সবার আগে কাবা শরিফ নির্মাণের প্রায় দুই হাজার বছর পর আল্লাহতায়ালা হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেন।সর্বপ্রথম বায়তুল্লাহ শরিফ মহান আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের মাধ্যমে তৈরি করেন।কাবা শরিফের ঠিক ওপরে ঊর্ধ্ব আকাশে 'বায়তুল মামুরে' ফেরেশতারা অনেক আগে থেকে তওয়াফ করে আসছিলেন। আল্লাহ তায়ালা জমিনের ফেরেশতাদের বললেন, 'তোমরা বায়তুল মামুরের আদলে একটি ঘর নির্মাণ করো।' তখন তাঁরা কাবা শরিফ নির্মাণ করেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাঁদের কাবাগৃহ তওয়াফ করার নির্দেশ দিলেন।ঐতিহাসিক আজরাকি বলেন, হযরত আদম (আ.) সৃষ্টির পূর্বে ফেরেশতাগণ এ ঘর নির্মাণ করেছিলেন। এ মতের পক্ষে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা).-এর একটি সহিহ বর্ণনা রয়েছে। ‘তাহজিবুল আসমা’ গ্রন্থে আল্লামা নববি (রহ.) ফেরেশতাদের নির্মাণকে সর্বপ্রথম বলে উল্লেখ করেন।
একাধিক হাদিসে এসেছে হযরত আদম (আ.) পৃথিবীতে প্রেরিত হওয়ার পর প্রথম বারের মতো তিনি এ কাবা গৃহটি তৈরী করেন।ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা হয়, আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.)কে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি সর্বপ্রথম মানব এবং এই গৃহটি সর্বপ্রথম গৃহ— যা মানব জাতির জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.)-এর পৃথিবীতে মিলন হলে তারা উভয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ হযরত আদম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন। এমন জায়গায় তৈরী করেন যার ঠিক উপরে সপ্তম আসমানে বায়তুল মামূর অবস্থিত এবং বায়তুল মামুরের আকৃতিতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন। এখানে হযরত আদম (আ.) সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন।অতঃপর হযরত আদম (আ.) পুনর্নিমাণ করেন জিব্রীলের ইঙ্গিত মতে। ইমাম বায়হাকি (রহ.) তার রচিত ‘দালাইলুন নবুওয়াহ’ গ্রন্থে একটি হাদিস উল্লেখ করেন, তা হলো, ‘মহান আল্লাহ ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) কে আদম ও হাওয়া (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে নির্দেশ দিলেন তোমরা উভয়ে আমার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করবে।অতঃপর জিবরাইল (আ.) একটি ঘর নির্মাণের ছক করে দিলেন। হযরত আদম (আ.) খনন করেন এবং বিবি হাওয়া (আ.) মাটি স্থানান্তর করেন। এক পর্যায়ে গায়েবি আওয়াজ আসে, ‘হে আদম! যথেষ্ট হয়েছে।’ ঘর নির্মাণ শেষে আল্লাহ তাঁকে ওই ঘর তাওয়াফের নির্দেশ দিলেন। বলা হলো, আপনি প্রথম মানুষ এবং এটি প্রথম ঘর।বর্ণিত আছে, হযরত আদম (আ.) পাঁচটি পাহাড়ের পাথর দিয়ে কাবাগৃহ নির্মাণ করেছেন। জাবালে হেরা, জুদি, লুবনান, সিনাই ও জাইতুন। আরো বর্ণিত আছে, ফেরেশতারা এ পাথরগুলো সঞ্চয় করে দিতেন।জালালাইনের বর্ণনা মতে, তখন থেকে নিয়ে পরবর্তীতে প্রায় দশবার পবিত্র কাবা শরিফকে নির্মাণ করা হয়।
হযরত শীস (আ.)ও বায়তুল্লাহ নির্মাণের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হযরত আদম (আ.) এর অসিয়তপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন, কাবা ঘরটি জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে আছে, তখন কাদামাটি ও পাথর জড়িয়ে শক্ত করে ঘরটি পুনঃনির্মাণ করেন। এ নির্মাণকাজ ছিল তৃতীয়বারের মতো।
নূহের তূফানের সময় বায়তুল্লাহর প্রাচীর বিনষ্ট হলেও ভিত্তি আগের মতই থেকে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর হুকুমে একই ভিত্তিভূমিতে ইব্রাহিম তা পুনর্নির্মাণ করেন।কোন কোন ভাষ্যকার বলেন আল্লাহ পাকের নির্দেশে হযরত জিব্রাইল (আ.) ইব্রাহিমকে কাবা শরীফের স্থান দেখিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন আমরা ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য, সালাতে দন্ডায়মানদের জন্য ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য’ (সুরা হজ্জ আয়াত- ২৬)।হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন স্থান নির্বাচিত হওয়ার পরে পিতা পূত্র মিলে আরম্ভ করে দিলেন গৃহ নির্মাণের কাজ। তাঁরা দুজনে ভিত্তির খনন কাজ আরম্ভ করলেন আর মুখে উচ্চারণ করতে লাগলেন“রব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আংতাস সামিউল আলীম”।আর স্মরণ করো, ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) যখন এই গৃহের প্রাচীর নির্মাণ করেছিল, তখন তারা দোয়া করে বলেছিল, “হে আমাদের রব! আমাদের এই খেদমাত কবুল করে নাও। তুমি সবকিছু শ্রবণকারী ও সবকিছু জ্ঞাতর।(সূরা আল-বাক্বারাহ-১২৭)।হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাঈল (আ.) দুজনে মিলে ভিত্তির জন্যে মাটি খনন করে ভিত্তির কাজ শুরু করে দিলেন। হযরত ইসমাঈল (আ.) পাথর বয়ে আনতেন আর বৃদ্ধ হযরত ইব্রাহিম (আ.) নির্মাণ কাজ করতেন।একপর্যায়ে কাবার দেয়াল যখন উঁচু হয়ে গেল তখন আল্লাহর কুদরতি 'লিফট' পাথর- 'মাকামে ইব্রাহিমে'র মাধ্যমে তিনি নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। তখন কাবার কোনো ছাদ নির্মাণ করা হয়নি।তখন কাবার উচ্চতা ৯ হাত, দৈর্ঘ্য ৩০ হাত ও প্রস্থ ২২ হাত ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সে নির্মাণের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় চার হাজার বছর।আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা জারি করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং (দীর্ঘ সফরের কারণে) সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হতে। যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং (কুরবানীর) নির্দিষ্ট দিনগুলিতে (১০, ১১, ১২ই যিলহাজ্জ) তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ পশু সমূহ যবেহ করার সময় তাদের উপরে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং আহার করাও অভাবী ও দুস্থদেরকে’ (সুরা হজ্জ আয়াত২৭-২৮)।ইব্রাহিম (আ.) মাক্বামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে এবং কোন কোন বর্ণনা মতে আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে দুই
কানে আঙ্গুল ভরে সর্বশক্তি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে চারদিকে ফিরে বারবার হজ্জের উক্ত ঘোষণা জারি করেন।
ইমাম বাগাভী হযরত ইবনু আববাসের সূত্রে বলেন যে, ইব্রাহিমের উক্ত ঘোষণা আল্লাহ পাক সাথে সাথে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের কানে কানে পৌঁছে দেন। ইবনু আববাস (রা) বলেন, ইব্রাহিমি আহবানের জওয়াবই হচ্ছে হাজীদের ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা লাববায়েক’ (হাযির, হে প্রভু আমি হাযির) বলার আসল ভিত্তি। সেদিন থেকে এযাবত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হ’তে মানুষ চলেছে কা‘বার পথে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ উটে, কেউ গাড়ীতে, কেউ বিমানে, কেউ জাহাযে ও কেউ অন্য পরিবহনে করে। আবরাহার মত অনেকে চেষ্টা করেও এ স্রোত কখনো ঠেকাতে পারেনি। পারবেও না কোনদিন ইনশাআল্লাহ। দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্ম উপেক্ষা করে সর্বদা চলছে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও ছাফা-মারওয়ার সাঈ। আর হজ্জের পরে চলছে কুরবানী। এভাবে ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের স্মৃতি চির অম্লান হয়ে আছে মানব ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে। এক কালের চাষাবাদহীন বিজন পাহাড়ী উপত্যকা ইব্রাহিমের দোয়া বরকতে হয়ে উঠলো বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সম্মিলন স্থল হিসাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,‘যখন আমরা কাবা গৃহকে লোকদের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তিধামে পরিণত করলাম (আর বললাম,) তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে সালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর। অতঃপর আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ই‘তেকাফকারী ও রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’ (সুরা বাক্বারাহ -১২৫)।‘(স্মরণ কর) যখন ইব্রাহিম বলল, পরওয়ারদেগার! এ স্থানকে তুমি শান্তির নগরীতে পরিণত কর এবং এর অধিবাসীদেরকে তুমি ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী দান কর- যারা তাদের মধ্যে আল্লাহ ও ক্বিয়ামত দিবসের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে। (আল্লাহ) বললেন, যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরকেও কিছু ভোগের সুযোগ দেব। অতঃপর তাদেরকে আমি যবরদস্তি জাহান্নামের আযাবে ঠেলে দেব। কতই না মন্দ ঠিকানা সেটা’ ( সুরা বাক্বারাহ- ১২৬)।
ইব্রাহিমের উপরোক্ত প্রার্থনা অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘যখন ইব্রাহিম বলল, হে আমার পালনকর্তা! এ শহরকে তুমি শান্তিময় করে দাও এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখ।’( সুরা ইব্রাহিম- ৩৫)। ‘হে আমার পালনকর্তা! এরা (মূর্তিগুলো) অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব যে আমার অনুসরণ করে, সে আমার দলভুক্ত আর যে আমার অবাধ্যতা করে, নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (সুরা ইব্রাহিম -৩৬)।অতঃপর কা‘বা গৃহ নির্মাণ শেষে পিতা-পুত্র মিলে যে প্রার্থনা করেন, তা যেমন ছিল অন্তরভেদী, তেমনি ছিল সুদূরপ্রসারী ফলদায়ক। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাঈল কা‘বা গৃহের ভিত নির্মাণ করল এবং দোয়া করল- ‘প্রভু হে! তুমি আমাদের (এই খিদমত) কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’। ‘হে প্রভু! তুমি আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহে পরিণত কর এবং আমাদের বংশধরগণের মধ্য থেকেও তোমার প্রতি একটা অনুগত দল সৃষ্টি কর। তুমি আমাদেরকে হজ্জের নীতি-নিয়ম শিখিয়ে দাও এবং আমাদের তওবা কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি তওবা কবুলকারী ও দয়াবান’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি এদের মধ্য থেকেই এদের নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ কর, যিনি তাদের নিকটে এসে তোমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী ও দূরদৃষ্টিময়’ (সুরা বাক্বারাহ-১২৭-১২৯)।ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের উপরোক্ত দোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে তাদের বংশে চিরকাল একদল মুত্তাকী পরহেযগার মানুষের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাঁদের পরের সকল নবী তাঁদের বংশধর ছিলেন। কা‘বার খাদেম হিসাবেও চিরকাল তাদের বংশের একদল দ্বীনদার লোক সর্বদা নিয়োজিত ছিল। কা‘বার খেদমতের কারণেই তাদের সম্মান ও মর্যাদা সারা আরবে এমনকি আরবের বাইরেও বিস্তার লাভ করেছিল। আজও সঊদী বাদশাহদের লক্বব হল ‘খাদেমুল হারামায়েন আশ-শারীফায়েন’ (দুই পবিত্র হরমের সেবক)। কেননা বাদশাহীতে নয়, হারামায়েন-এর সেবক হওয়াতেই গৌরব বেশী।ইব্রাহি্মের দোয়ার ফসল হিসাবেই মক্কায় আগমন করেন বিশ্বনবী ও শেষনবী মুহাম্মাদ (সা)। তিনি বলতেন - ‘আমি আমার পিতা ইবরাহীমের দোয়ার ফসল ও ঈসার সুসংবাদ’।এই মহানগরীটি সেই ইবরাহীমী যুগ থেকেই নিরাপদ ও কল্যাণময় নগরী হিসাবে অদ্যাবধি তার মর্যাদা বজায় রেখেছে। জাহেলী আরবরাও সর্বদা একে সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখত। এমনকি কোন হত্যাকারী এমনকি কোন পিতৃহন্তাও এখানে এসে আশ্রয় নিলে তারা তার প্রতিশোধ নিত না। হরমের সাথে সাথে এখানকার অধিবাসীরাও সর্বত্র সমাদৃত হতেন এবং আজও হয়ে থাকেন।
মাকামে ইব্রাহিম

মাকামে ইব্রাহিম ও হাজরে আসওয়াদ- কাবা ঘরের দেয়াল উচু হয়ে গেলে (উচ্চতা কোমর পর্যন্ত হলে) ইব্রাহিম (আ.) এর পক্ষে তা নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। তখন ইসমাইল (আ.) একটি পাথর খন্ড সংগ্রহ করে নিয়ে এলেন। (উচ্চতা কোমর পর্যন্ত হলে আমাদের দেশে বাশেঁর মাচা তৈরী করে) হযরত ইব্রাহিম আ. এর উপর দাঁড়িয়ে কাবা ঘরের গাঁথুনী কর্ম সম্পাদন করেন।হাদিসে এসেছে কাবা ঘরের দেয়াল যতই উচু হতে লাগল পাথরটির উচ্চতাও ততই বৃদ্ধি পেতে লাগলো।এই পাথর কাবা ঘর নির্মাণের সময় হযরত ইবরাহিম (সা) জন্য লিফটের দায়িত্ব পালন করেছিল।পাথরটির পৃষ্ঠে ইব্রাহিম আ. এর দু পায়ের স্পষ্ট ছাপ আজও বিদ্যমান। যা একটু গভীর ভাবে লক্ষ্য করলেই দর্শকের কাছে পরিলক্ষিত হবে। কাবা ঘরের চতুর্দিকের দেয়াল নির্মাণে এ পাথরটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যবহার করতেন। তখন থেকে এ পাথরটি মাকামে ইব্রাহিম নামে পরিচিত ।কাবা শরিফের পাশেই চারদিকে লোহার বেষ্টনীর ভেতর একটি ক্রিস্টালের বাক্সে আছে বর্গাকৃতির একটি পাথর। পাথরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান—প্রায় এক হাত। এটিই মাকামে ইব্রাহিম। মাকাম শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে দাঁড়ানোর স্থান। অর্থাৎ, হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দাঁড়ানোর স্থান।
হাজরে আসওয়াদ

অবশেষে গৃহের সম্মুখে এসে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করলেন। (তখনও পর্যন্ত কাবার কোন ছাদ ছিলো না)।দেয়ালের গাঁথুনি যখন বর্তমানে রক্ষিত হাজরে আসওয়াদের উচ্চতা পর্যন্ত পৌঁছালো তখন ইব্রাহিম (আ.) বললেন, ইসমাইল এখানে সুন্দর একটি পাথর স্থাপন করো, যাতে এদিকে তাওয়াফকারীদের অন্তর আকৃষ্ট হয়। ইসমাইল (আ.) অনেক অনুসন্ধান করে একটি পাথর নিয়ে এলেন। কিন্তু ইব্রাহিমের তা মনঃপুত হলো না। তিনি এর চেয়ে সুন্দর পাথর সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিলেন। পূনরায় অন্বেষণে লিপ্ত হলেন হযরত ইসমাইল (আ.)। পাহাড়ে পাহাড়ে সুন্দর পাথর খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় আবু কুবাইস পাহাড় থেকে উচ্চারিত হলো - হে ইসমাঈল! আপনার একটি গচ্ছিত সম্পদ রয়েছে আমার জিম্মায়।সম্পদটি নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করুন। হযরত নূহ (আ.) এর প্লাবনে হযরত আদম (আ.) নির্মিত কাবা প্লাবিত হয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালা জিব্রাইলকে নির্দেশ দেন হাজরে আসওয়াদ পাথরটি সংরক্ষণ করার জন্য।আদম (আ.) জান্নাত থেকে আসার সময় এ পাথরটি নিয়ে এসেছিলেন এবং তিনি কাবা নির্মাণের পরে এ পাথরটি দেয়ালে স্থাপন করেছিলেন। জিব্রাইল আ. পাথরটি নিয়ে আবু কুবাইস পর্বতে রেখে দেন। হযরত ইসমাইল (আ.) পর্বতের ভিতর হতে পাথরটি নিয়ে কাবা শরীফের দেয়ালে রাখলেন। যাতে করে এ পাথর থেকে মানুষ কাবা গৃহের তাওয়াফ আরম্ভ করতে পারেন। এভাবেই হাজরে আসওয়াদ পেলো তার যথাযথ অবস্থান।হাদিসের গ্রন্থগুলোতে হাজরে আসওয়াদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রচুর আলোচনা এসেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হাজরে আসওয়াদ একটি জান্নাতি পাথর, তার রং দুধের চেয়ে বেশি সাদা ছিল। এরপর বনি আদমের পাপরাশি এটিকে কালো বানিয়ে দিয়েছে।’ (জামে তিরমিজি - ৮৭৭, মুসনাদে আহমাদ- ১/৩০৭, ৩২৯)।অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘হাজরে আসওয়াদ জান্নাতেরই একটি অংশ।’ (ইবনে খুজায়মা, খণ্ড,০৪, পৃষ্ঠা-২২০)।তখন এ পাথরটির শুভ্রতা এত বেশী প্রখর ছিল যে এর আলোতে পারিপার্শ্বিক অঞ্চল সমূহ আলোকিত হয়ে যেত। কিন্তু পরবর্তীতে কাবাগৃহে দুবার আগুন লেগে পাথরটি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং কালো বর্ণ ধারণ করে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)।অন্ধকার যুগের অপবিত্রা এক নারীর স্পর্শে পাথরটি হয়ে পড়ে জ্যোতিহীন, কালো।(তাফসীরে মাজহারী)। মুশরিকদের অপবিত্র স্পর্শ্বের কারণেই নাকি তা কালো বর্ণে পর্যবসিত হয়। এ পাথরটিই বর্তমানে পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান একমাত্র পাথর যা বেহেশত হতে প্রেরিত। এটা আল্লাহর একটা বিশাল কুদরত। হাজী সাহেবানদের জন্য এ পাথরে চুমু দিতে পারার সুযোগ এক বিরল সৌভাগ্যই বটে। এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। বর্তমানে এটি আট টুকরো। আগে হাজরে আসওয়াদ ছিল আস্ত একটি পাথর। হজরত আবদুল্লাহ বিন জোবায়েরের শাসনামলে কাবা শরিফে আগুন লাগলে হাজরে আসওয়াদ কয়েক টুকরা হয়ে যায়। আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের পরে ভাঙা টুকরাগুলো রুপার ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেন। ফ্রেম সংস্করণের সময় চুনার ভেতর কয়েকটি টুকরা ঢুকে যায়। বর্তমানে হাজরে আসওয়াদের আটটি টুকরা দেখা যায়। বড় টুকরাটি খেজুরের সমান।হাজরে আসওয়াদ হলো কালো রঙের প্রাচীন পাথর বর্তমানে যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে দেড় মিটার (চার ফুট) উঁচুতে অবস্থিত।
কাবা পুনর্নির্মাণ- আল্লাহ রাববুল আলামিন হযরত ইব্রাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশ হতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে শেষ নবী ও রাসূল হিসেবে আল্লাহ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিবাহিত হলো।হযরত ইবরাহিম আ. এর পরও বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় প্রয়োজনে বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবাঘর এর সংস্কারের খেদমত করেন। যেমন, পঞ্চমবার আমালিকা সম্প্রদায়, ষষ্ঠবার জুরহুম কাবিলার নির্মাণ এবং সপ্তমবার নির্মাণ করেন কুসাই ইবনে কিলাব।৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার শাসক হলেন আবদুল মুত্তালিব। তিনিই প্রথম কাবায় স্বর্ণখচিত লৌহদরজা নির্মাণ করেন। অষ্টমবার নির্মাণের কাজে হাত দেন কুরাইশ সম্প্রদায়।মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির ৫ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার করে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশ। এ কুরাইশ বংশেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সরাসরি সহিহ হাদিসে এসেছে যে, ইবরাহীম (আ) নির্মিত এই প্রাচীর জাহেলিয়াত যুগে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে কুরাইশরা তা নতুনভাবে নির্মান করে। এ নির্মাণ কাজে আবু তালেবের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়তের পূর্বে অংশগ্রহণ করেন। (মুসলিম- ৩৪০)। এ নির্মাণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, কুরাইশরা কাবার উচ্চতা আরো ৯ হাত বৃদ্ধি করে মোট ১৮ হাত (৪৩২ সে.) নির্মাণ করেন এবং তাঁরাই প্রথম কাবার পূর্ণ ছাদ নির্মাণ করেন। আর কাবার পশ্চিম দরজা একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পূর্ব দিকের দরজাটি একটু উঁচু করে দেওয়া হয়, যাতে অন্য কেউ প্রবেশ করতে না পারে। পুরো নির্মাণকাজ বৈধ অর্থে পরিচালিত হলেও অর্থকষ্টে তাঁরা উত্তর দিকে চিহ্ন রেখে ৭ হাত (৩ মিটার) বাদ দিয়ে দেন। এ ছাড়া তারা পানি নির্গমনের জন্য 'মিজাব' বা নালা তৈরি করেন।কুরাইশদের কাবা শরীফ সংস্কারের পর হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। সকলের সম্মতিক্রমে আল্লাহর রাসূল কাবা গৃহে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করেন। ইবনে আসিরের বর্ণনা মতে ৬৫ হিজরীতে আব্দুল্লাহ ইবনে জোবায়ের (রা.) কাবা শরীফ সংস্কার করেন। ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে হুসাইন নামক এক ব্যক্তির মিনজানিক ব্যবহারের দরুন মতান্তরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মিনজানিক হামলার কারণে কাবা শরিফ পুড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে তা পুনর্নির্মাণের তীব্র প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কুরাইশদের বাদ দেওয়া 'হাতিম'কে তিনি কাবার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন। কাবাকে তিনি পুরো ইব্রাহিমি কাঠামোতে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গমন-বহির্গমনের সুবিধার্থে তিনি 'মাতাফে'র সঙ্গে মিশিয়ে দুটি দরজা নির্মাণ করে সর্বসাধারণের জন্য অবমুক্ত করে দেন। ছাদের ভারসাম্য রক্ষার্থে তিনি কাবার অভ্যন্তরে তিনটি কাঠের স্তম্ভ স্থাপন করেন এবং কাবার উচ্চতা আরো ১০ হাত বৃদ্ধি করে দেন।হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৭৪ হিজরীতে কাবা শরীফ সংস্কার করেন। ৭৪ হিজরিতে আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসনামলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আবদুল্লাহ বিন জোবা্যের (রা.)-কে শহীদ করেন। আবদুল্লাহ বিন জোবা্যের কাবা নির্মাণকে হাজ্জাজ আত্মচিন্তাপ্রসূত জ্ঞান করে কাবাকে কুরাইশি কাঠামোতে ফিরিয়ে নিতে উৎসাহী হন। ইবনে মারওয়ানের সম্মতিক্রমে তিনি ইবনে জুবাইরের স্মৃতিচিহ্নকে ধুলায় ধূসরিত করে দেন। তিনি ইব্রাহিমি কাঠামো পরিবর্তন করে কাবাকে কুরাইশি ফ্রেমে বন্দি করেন। পরবর্তী সময়ে হজরত আয়েশা (রা.)-এর হাদিস শুনে ইবনে মারওয়ান খুবই অনুতপ্ত হয়েছেন বলে জানা যায়। এরপর বাদশাহ হারুনুর রশিদ কাবাকে ইবনে জুবাইরের আদলে নির্মাণ করতে চাইলে ফেতনার আশঙ্কায় তৎকালীন আলেম সমাজ বিশেষত ইমাম মালেক (রহ.) তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।এর পর থেকে নির্র্মাণের পরিবর্তে কাবা শরিফের সংস্কারকাজ অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে। সুদীর্ঘ ১৪শ' বছরে কাবাগৃহে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন হয়নি। শুধুমাত্র কাবাঘরের চারপাশে অবস্থিত মসজিদে হারামের পরিবর্ধন, সংস্কার বা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল