অমুসলিমদের জানমাল ও উপাসনালয়ের নিরাপত্তায় ইসলাম

মো. আবু রায়হানঃমানুষের মধ্যকার বিরোধ অবধারিত হলেও সব ধর্ম ও মতাদর্শের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং কোনো উপাসনালয়ে হামলা যেকোনো আইনের চোখে অপরাধ। শান্তির ধর্ম ইসলাম এ বিষয়ে সর্বাধিক সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। প্রয়োজনে অন্য ধর্মের উপাসনালয় রক্ষায় যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। এ বিষয়ে কোরআনের ভাষ্য এমন : ‘...আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিস্টান সংসারবিরাগীদের উপাসনাস্থল, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ, যার মধ্যে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়...।’ (সুরা  হজ আয়াত - ৪০)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং কোরানে বলেছেন, “তোমার ধর্মের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেনি, তোমার বসতি থেকে তোমাকে উচ্ছেদ করেনি, তাদের প্রতি তোমার দয়ালু হওয়া উচিৎ এবং তাদের সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায় ভালোবাসেন।” (৬০ / ৮)।
অমুসলিম নাগারিককে হত্যা করা সম্পর্কে রাসুলে মকবুল (সঃ) বলেছেন, “যে কোন সংখ্যালঘুকে হত্যা করবে সে বেহেশতের ঘ্রাণও উপভোগ করতে পারবেনা। অথচ বেহেশতের সুঘ্রাণ চল্লিশ বছরের দূরত্ব হতেও অনুভব করা যাবে।” (অমুসলিমের প্রতি ইসলামের উদারতা- ডাঃ ইউসুফ আল-কারযাভী-অনুবাদক, মাহমুদুল হাসান-পৃ ২১-২২)!
মহানবী (সঃ) একদিন মসজিদে নববীতে কতিপয় সাথীদের নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুইন এসে মসজিদের ভিতরে এক কোনে প্রস্রাব করছিলো। রাসুল (সঃ) এর সাথীরা ওকে প্রহার করতে উদ্যত হলে মহানবী (সঃ) তাদেরকে নিবৃত্ত করলেন। প্রস্রাব করা শেষ হলে শান্তির দূত মুহাম্মদ (সঃ) তাকে বুঝিয়ে বললেন যে, “ওটা মুসলমানদের ইবাদতখানা, প্রস্রাবের স্থান এটা নয়।” এ-বলে তিনি তাকে বিদায় দিয়ে সাথীদের নিয়ে মসজিদের প্রস্রাব ধুয়ে দিলেন
অমুসলিমদের উপাসনালয় রক্ষায় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) একটি রাজকীয় ফরমান জারি করেছিলেন। বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিস্টানদের জন্য তিনি একটি সংবিধান রচনা করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি একটি নিরাপত্তাসংক্রান্ত চুক্তিনামা, যা মুসলমানদের আমির, আল্লাহর বান্দা ওমরের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরিত হলো। এই চুক্তিনামা ইলিয়্যাবাসী তথা জেরুজালেমে বসবাসরত খ্রিস্টানদের জীবন ও সম্পদ, গির্জা-ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ তথা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য। সুতরাং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তাদের উপাসনালয়ে অন্য কেউ অবস্থান করতে পারবে না। তাদের গির্জা ধ্বংস করা যাবে না এবং কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন করা যাবে না। তাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো বস্তু, তাদের ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ও তাদের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধন বা হামলা করা যাবে না। (তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক, তারিখে তাবারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯)।
অন্যের উপাসনালয় ভেঙে ফেলার অনুমতি ইসলাম দেয়নি। মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে নিন্দনীয়। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) ‘হীরা’ নামক স্থানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে চুক্তি করেছিলেন, তাতে বলা হয়েছে, ‘তাদের গির্জা তথা ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংস করা যাবে না এবং তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া যাবে না। এবং ঘণ্টা বাজানো থেকে তাদের নিষেধ করা যাবে না। ধর্মীয় উৎসব উদ্‌যাপনের সময় ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ বের করাতে বাধা দেওয়া যাবে না।’ (ফতোয়ায়ে হক্কানিয়া : ৫/৪৮৫)
ঐতিহাসিকভাবে ইসলামে অমুসলিমদের প্রতি ইনসাফের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। মদিনার ইহুদিরা সব সময় ইসলামের বিরোধিতা করত, তথাপি রাসুল (সা.) তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। একবার মদিনার মসজিদে বসে নবী (সা.) নাজরান থেকে আগত একটি খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার বিরতিতে তারা স্বধর্ম অনুসারে প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী করিম (সা.) তাদের মদিনার মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি দেন। (ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ৭।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর খেলাফতকালে যখন মিসরের শাসনকর্তা হিসেবে হযরত আমর ইবনুল আ’ স (রাঃ) দায়িত্ব পালন করছিলেন, সে সময় একদিন আলেক জান্দ্রিয়ার খ্রীষ্টান পল্লীতে হৈ - চৈ পড়ে গেলো। কেউ একজন যিশু খ্রীষ্টের প্রস্তরনির্মিত মূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেলছে। খ্রীষ্টানরা ধরে নিল যে এটা মুসলমানদের কাজ। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। খ্রীষ্টান বিশপ অভিযোগ নিয়ে আসলেন আমর ইবনুল আ’ স এর কাছে। আমর শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তিনি ক্ষতিপূরণ স্বরূপ মূর্তিটি নতুনভাবে তৈরি করে দিতে চাইলেন। কিন্তু খ্রীষ্টান নেতাদের প্রতিশোধ স্পৃহা ছিলো অন্যরকম। তারা চাইলো মুহাম্মদ (সাঃ) এর মূর্তি তৈরি করে অনুরূপভাবে নাক ভেঙ্গে দিতে। খ্রীষ্টানদের এ মতামত ব্যক্ত করার মধ্যে দিয়ে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের কতটুকু বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায়। যে নবী (সঃ) আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সে নবীর মূর্তি তৈরীকে মুসলমানরা কিভাবে মেনে নিতে পারে? হযরত আমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে খ্রীষ্টান বিশপকে বললেন, “ আমার অনুরোধ, এ প্রস্তাব ছাড়া অন্য যে কোন প্রস্তাব করুন আমি রাজি আছি। আমাদের যে কোন একজনের নাক কেটে আমি আপনাদের দিতে প্রস্তুত, যার নাক আপনারা চান।” খ্রীষ্টান নেতারা সকলে এ প্রস্তাবে সম্মত হলো। পরদিন খ্রীষ্টান ও মুসলমান বিরাট এক ময়দানে জমায়েত হলো। মিসরের শাসক সেনাপতি আমর (রাঃ) সবার সামনে হাজির হয়ে বিশপকে বললেন, “এদেশ শাসনের দায়িত্ব আমার। যে অপমান আজ আপনাদের, তাতে আমার শাসন এর দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই তরবারী গ্রহণ করুন এবং আপনিই আমার নাসিকা ছেদন করুন।” একথা বলেই তিনি বিশপকে একখানি ধারালো  তরবারী হাতে দিলেন। জনতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খ্রীষ্টানেরা স্থম্বিত। চারদিকে থমথমে ভাব। সে নীরবতায় নিঃশ্বাসের শব্দ করতেও যেন ভয় হয়। সহসা সেই নীরবতা ভংগ করে একজন মুসলিম সৈন্য এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বললো, “আমিই দোষী, সিপাহসালারের কোন অপরাধ নেই। আমিই মূর্তির নাক ভেঙ্গেছি, এই, তা আমার হাতেই আছে। তবে মূর্তি ভাঙ্গার কোন ইচ্ছা আমার ছিলোনা। মূর্তির মাথায় বসা একটি পাখির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।” সৈন্যটি এগিয়ে এসে বিশপের তরবারীর নীচে নিজের নাসিকা পেতে দিলো। স্তম্ভিত বিশপ। নির্বাক সকলে। বিশপের অন্তরাত্মা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। তরবারী ছুঁড়ে দিয়ে বিশপ বললেন, “ধন্য সেনাপতি, ধন্য এই বীর সৈনিক, আর ধন্য আপনাদের মুহাম্মদ (সঃ), যাঁর মহান আদর্শে আপনাদের মতো মহৎ উদার নির্ভিক ও শক্তিমান ব্যক্তি গড়ে উঠেছে। যিশু খ্রীষ্টের প্রতিমূর্তির অসম্মান করা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চাইতেও অন্যায় হবে যদি অঙ্গহানি করি। সেই মহান ও আদর্শ নবীকেও আমার সালাম জানাই।” পরধর্ম সহিষ্ণুতার এ জলন্ত উদাহরণ আজো বিশ্ববাসিকে হতবাক করে।
মানবতার বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে সহাবস্থান ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনের বিকল্প নেই।ইসলাম সেই সহাবস্থানের নীতি সুনিশ্চিত করেছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল