সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মসজিদ থেকে মন্দির

 

ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের একজন সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৯ সালে ‘বাবরি মসজিদ’ তৈরি করেন। ১৮২২ সালে প্রথমবারের মত ফৈজাবাদ আদালতের এক চাকরিজীবী দাবি করেন যে, মসজিদটি যে মন্দিরের জমির উপরে অবস্থিত। নির্মোহী আখড়া সংগঠন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঐ জমির উপরে তাদের দাবি জানায়। ১৮৫৫ সালে ঐ ভূখণ্ডের দখল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন সংঘর্ষ এড়াতে দেয়াল দিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের প্রার্থনার জায়গা আলাদা করে দেয়। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলছিল।ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক বছর দুয়েকের মাথায় ১৯৪৯ সালে মসজিদের ভেতরে হঠাৎ একদিন সকালে রহস্যময়ভাবে ‘রামলালা’র (শিশু রামচন্দ্র) মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। তারিখটা ছিল ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৪৯ মধ্যরাতের পর। হিন্দু মহাসভার সদস্যদের মসজিদের অভ্যন্তরে রাম মূর্তি স্থাপন করার অভিযোগে দুই পক্ষের মাঝে সৃষ্টি হয় উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং তারা আইনের আশ্রয় নেয়। স্থানীয় মুসলিমরা অবশ্য অভিযোগ করেন রাতের অন্ধকারে গোপনে মসজিদের ভেতরে ওই মূর্তিটি রেখে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু রামলালার ‘আবির্ভাবে’র খবর ততক্ষণে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ওই মসজিদে এসে শ্রীরামের ভজন-পূজন শুরু করে দেয়।
গবেষক ও লেখক অরিন্দম সেন অবশ্য জানাচ্ছেন, রহস্য-ফহস্য কিছু নয় – খুব কৌশলে পরিকল্পনা এঁটেই মসজিদের ভেতরে ওই মূর্তি নিয়ে আসা হয়েছিল।‘মন্দির বিতর্কের পাঁচ দশক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “কথিত আবির্ভাবের ঠিক আটদিন আগে থেকে অযোধ্যায় শুরু হয়েছিল রামনাম সংকীর্তন। বলা হয়েছিল, আটদিন সংকীর্তনের শেষে নাকি শ্রীরামচন্দ্র অবির্ভূত হবেন।”“বাস্তবেও ঠিক সেটাই হলো– আর কোথায় তিনি আবির্ভূত হলেন? একেবারে সোজা মসজিদের ভেতরে!”
‘অযোধ্যা – দ্য ডার্ক নাইট’ নামের গ্রন্থেও ১৯৪৯ সালের ২২/২৩ ডিসেম্বর রাতের সেই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের পূর্বাপর বর্ণনা করেছেন অনুসন্ধানী দুই লেখক, কৃষ্ণা ঝা ও ধীরেন্দ্র কুমার ঝা।
তাদের গবেষণা বলছে, রামলালার আবির্ভাবের পরদিন স্থানীয় থানায় যে এফআইআর দায়ের হয়, তাতে মসজিদের ভেতরে ঢুকে মূর্তি রেখে আসার জন্য মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল অভিরাম দাস নামে এক তরুণ হিন্দু সন্ন্যাসীকে। প্রমাণের অভাবে তার কোনও সাজা হয়নি, কিন্তু লোকের মুখে মুখে তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘রামজন্মভূমি উদ্ধারক’ বা ‘উদ্ধারক বাবা’।
সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় মসজিদের ভেতর থেকে রামলালার বিগ্রহ কিন্তু সরানো যায়নি। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৪৫ ধারা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ গোটা কাঠামোটি ‘বিতর্কিত স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করে ।
শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় সরকার মসজিদের দরজায় তালা লাগায় এবং সেখানে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়।ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর নির্দেশেই বাবরি মসজিদে তালা লাগানো হয়েছিল। আর সেই তালা যখন খোলা হয়, তখন দেশের ক্ষমতায় ছিল তারই দৌহিত্র বা নাতি রাজীব গান্ধীর সরকার।
আশির দশকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সাথে নিয়ে ঐ স্থানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারাভিযান চালায়। তাদের প্রচারাভিযানের আগুনে ঘি ঢালেন এক জেলা জজ, যিনি ১৯৮৬ সালে দরজার তালা খোলার এবং ঐ স্থানে হিন্দুদের প্রার্থনা করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। আদালতের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, যিনি শাহ বানো বিতর্কের দরুন গোঁড়া হিন্দুদের সমর্থন হারানোর পর পুনরায় গোঁড়া হিন্দুদের সমর্থন লাভে উদ্যত হয়েছিলেন।
১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপি নেতা এল. কে. আদভানি রাম রথযাত্রা নামের একটি রাজনৈতিক শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। শোভাযাত্রাটি গোটা উত্তর ভারত ঘুরে অযোধ্যাতে এসেছিল। এই শোভাযাত্রা প্রস্তাবিত মন্দিরের জন্য সমর্থন আনার জন্য এবং মুসলিমবিরোধী মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু ভোটগুলোকে একটি দলের বাক্সে আনার পক্ষে কাজ করেছিল। অযোধ্যায় পৌঁছানোর পূর্বে বিহার প্রাদেশিক সরকার তাকে গ্রেফতার করে। তা সত্ত্বেও, বহু করসেবক বা সংঘ পরিবার কর্মী অযোধ্যায় পৌঁছেছিল এবং মসজিদটি আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল। ফলশ্রুতিতে, আধাসামরিক বাহিনীর সাথে তারা পূর্বপরিকল্পিত সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষের ফলে কিছু করসেবক নিহত হন।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো ঐ বিতর্কিত স্থানে এক শোভাযাত্রার আয়োজন করে। শোভাযাত্রায় শামিল হয়েছিল দেড় লাখ ভিএইচপি এবং বিজেপি "কর সেবক"। এছাড়া, অনুষ্ঠানে আদভানি, মুরলি মনোহর জোশি ও উমা ভারতীর মত বিজেপি নেতা ভাষণ দিয়েছিলেন। শোভাযাত্রা চলাকালের প্রথম দিকে জনতা ক্লান্তিহীনভাবে স্লোগান দিচ্ছিল। সহিংসতা প্রতিরোধে স্থাপনাটির চারদিকে পুলিশি বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল। দুপুরের দিকে এক যুবক বেষ্টনী অতিক্রম করে স্থাপনাটির উপরে চলে যায় এবং গেরুয়া পতাকা উত্তোলন করে। এই ঘটনা ছিল সহিংসতার আগমনবার্তা। এরপর, উন্মত্ত জনতার সামনে পুলিশি বেষ্টনী বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। এরপর, উন্মত্ত জনতা কুঠার, হাতুড়ি এবং গাইতি দিয়ে ইমারতটি ভাঙা শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মাঝে কাদা ও চুনাপাথর দ্বারা নির্মিত ইমারতটি মাটির সাথে মিশে যায়। ১৯৯২ সালে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত বাবরি মসজিদে আর কখনও নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।২০২৪ সালের ২২ জানুয়ারি বহু বিতর্ক এবং আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে উদ্বোধন হচ্ছে রামমন্দিরের। উদ্বোধন হলো রামলালার বিগ্রহে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...