নবীজির জীবদ্দশায় শেষ অভিযান
নবম হিজরি, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবুক মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। মদিনা থেকে এটি ৬৯০ কিলোমিটার দূরে এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক থেকে ৬৯২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের ও মুনাফিকদের শেষ চেষ্টা।
রোমানদের দ্বারা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)-কে হত্যার মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এ যুদ্ধে নবী করিম (সা.) ৩০ হাজার যোদ্ধা সাহাবির এক বাহিনী নিয়ে তাবুক অভিমুখে রওনা হন। এটাই ছিল নবী করিম (সা.)-এর জীবনের সবচেয়ে বড় ও শেষ সেনা অভিযান।
আল্লাহ তাআলা এ যুদ্ধের প্রক্কালে কুরআনে উল্লেখ করেন, ‘যদি তোমরা অভিযানে বের না হও, তবে আল্লাহ তোমাদের কঠিন শাস্তি দেবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য কোনো জাতিকে নিয়ে আসবেন। আর তোমরা কিন্তু তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা তাওবা, আয়াত ৩৯)
নবী করিম (সা.) মক্কা বিজয় ও হুনায়েনের যুদ্ধ শেষে যখন মদিনায় ফিরে এলেন, এর কিছুদিন পর শাম (সিরিয়া) থেকে ফিরে আসা কতিপয় বণিক দলের কাছ থেকে খবর পেলেন, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদিনা আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে শাম ও আরব সীমান্তে তারা এক বিশাল বাহিনী মোতায়েন করছে। এ খবরে মদিনায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়; যদিও
যদিও সাহাবায়ে কেরাম এযাবৎ বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তবু এ সবই ছিল জাজিরাতুল আরবের ভেতরে। কোনো বহিঃশত্রু বা রাজকীয় বাহিনীর মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তা ছাড়া রোম ছিল তৎকালীন দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি। মহানবী (সা.) ফয়সালা করলেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের অপেক্ষা না করে মুসলমানরা নিজেরাই আগে তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে। সুতরাং তিনি মদিনার সব মুসলিমকে এ যুদ্ধে শরিক হওয়ার নির্দেশ দিলেন। এটা ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কেননা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে বহু যুদ্ধের পর এটা ছিল মুসলমানদের কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সময়।
দ্বিতীয়ত, এটা ছিল মদিনাবাসীর প্রধান খাদ্য খেজুর পাকার সময়। সারা বছরের খেজুর তাদের তখনই সংগ্রহ করতে হতো। এ সময় বাগান ছেড়ে যাওয়াটা তাদের জন্য ছিল কঠিন কাজ।
তৃতীয়ত, এটা ছিল আরব অঞ্চলে তীব্র গরমের সময়। চতুর্থত, তাবুকের সফর ছিল অনেক দীর্ঘ ও দুর্গম। প্রায় পুরো পথই ছিল দুর্গম মরুভূমি।
পঞ্চমত, মদিনায় তখন খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।
ষষ্ঠত, তাদের যুদ্ধসরঞ্জাম ও বাহন পশুরসংখ্যা ছিল খুব কম। সর্বোপরি তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়া ছিল অনেক কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) ৩০ হাজার যোদ্ধা সাহাবির এক বাহিনী নিয়ে তাবুক অভিমুখে রওনা হন। হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা জানতে পেরে কালবিলম্ব না করে সেখান থেকে তাঁর বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। এই যুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এমন কিছু সাহাবিও ছিলেন, যাঁদের কাছে এ অভিযান অত্যন্ত কঠিন মনে হয়েছিল। শুরুর দিকে তাঁরা কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরাও সৈন্যদের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হয়েছিলেন। এর পরও হাতে গোনা কিছু সাহাবি এমন রয়ে গিয়েছিলেন, যাঁরা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে মুসলমান দাবিদার কিছু মোনাফিকও ছিল, যারা এই বিপৎসংকুল যুদ্ধাভিযান থেকে শুধু নিজেরাই গা বাঁচানোর চেষ্টা করেনি, অন্যদেরও অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
পৃথিবী থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন করতে রোমানরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে এলেও উভয় পক্ষের মাঝে কোনো লড়াই হয়নি। সম্মুখ লড়াইয়ের আগেই রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস ভীত হয়ে রণাঙ্গন ত্যাগ করেন।এই অভিযানে মদীনার উত্তরের বিভিন্ন গোত্র মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে দ্বিতীয় হিজরীতে ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) যখন তাঁর নবজাত রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, বদরের প্রান্তরে তখন তাঁর সাথে ছিল মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য। আর মাত্র সাত বছর পর যখন বিশ্ববিজয়ী রোমানদের সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধের জন্য তাবুকে অভিযান চালালেন, তখন তাঁর সাথে ছিল ৩০ হাজার সৈন্য। এর দু'বছর পর একাদশ হিজরীতে যখন মহানবী (সাঃ) ইন্তিকাল করেন, তখন তার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি একটি সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা সিরিয়া থেকে এডেন এবং ইরাক থেকে জেদ্দা পর্যন্ত তথা এক মিলিয়ন বর্গমাইল বিস্তুৃতি লাভ করেছিল। অথচ এত বড় একটা সাম্রাজ্য কায়েম করতে যে অনুপাতে রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, তা-ও হয়নি। কারণ তাঁর প্রতিটি যুদ্ধই ছিল প্রতিরক্ষামূলক। যদি তিনি আলেকজান্ডার বা অন্যান্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকারীদের মতো দেশ জয়ে বের হয়ে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ করতেন, তাহলে লাখো লাখো মানুষের রক্তে পৃথিবীর মাটি সিক্ত হতো। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, শত্রুপক্ষে মাত্র ১৫০ জন লোক নিহত হয়েছিল: তাও বিশ্বাসঘাতক ইয়াহুদী গোত্র বনু কুরাইযাদের ধর্মানুসারে মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে। আর মুসলমানদের পক্ষে শহীদ হয় দশ বছরের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে একজন করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন