সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুলতান রাজিয়া ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক



সুলতান রাজিয়া ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক। সেই সঙ্গে নারী শাসকদের মধ্যে প্রথম মুসলিম নারী শাসক ছিলেন সুলতান রাজিয়া।Razia Sultan was the first Muslim woman to rule India and the only woman to have sat on the throne of Delhi. She was the fifth ruler of the Mamluk Dynasty of the Delhi Sultanate.তিনি ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত প্রায় চার বছর রাজত্ব করেছিলেন।সুলতান রাজিয়া (১২০৫ - ১২৪০) ইংরেজি ইতিহাস বইসমূহে রাজিয়ার নাম Raḍiyya বা Raziyya হিসাবেও অনুবাদ করা হয়েছে। কিছু আধুনিক লেখক "সুলতানা" শব্দটি ব্যবহার করেন, এটি একটি ভুল নাম। কারণ এর প্রকৃত অর্থ "নারী শাসক" না বরং "রাজার স্ত্রী"। রাজিয়া'র নিজস্ব মুদ্রাগুলো তাকে সুলতান জালালত আল-দুনিয়া ওয়াল-দ্বিন বা আল-সুলতান আল-মুয়াজ্জম রাজিয়ত আল-দ্বিন বিনতে আল-সুলতান নামে অভিহিত করে। সালতানাতের সংস্কৃত ভাষার শিলালিপি তাকে জাল্লালাদিন বলে, আর প্রায় সমসাময়িক ইতিহাসবিদ মিনহাজ তাকে সুলতান রাজিয়ত আল-দুনিয়া ওয়া'ল দিন বিনতে আল-সুলতান বলে অভিহিত করেন। তিনি ছিলেন সুলতান ইলতুৎমিসের কন্যা ও ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। তিনি একাধারে একজন ভালো প্রশাসক ও সেনাপতি ছিলেন; তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈন্য হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সুলতান ইলতুৎমিসের সব থেকে যোগ্য পুত্র সুলতানের জীবদ্দশায় মৃত্যু বরণ করলে সুলতান তার কন্যা রাজিয়া কে দিল্লির শাসক হিসেবে মনোনীত করে যান। যখনই ইলতুৎমিসের রাজধানী ছাড়তে হত, তিনি তখন তার কন্যা রাজিয়াকে শাসনভার বুঝিয়ে দিয়ে যেতেন। রাজিয়া ছিলেন সুলতানের জ্যেষ্ঠা কন্যা, বুদ্ধিমতী ও যুদ্ধবিদ্যায় পটু।

রাজিয়া অন্তঃপুরিকা ছিলেন না। তিনি প্রকাশ্য দরবারে রাজকীয় পোশাক পরিধান করে সিংহাসনে আরোহন করতেন। তিনি কোন ঘোমটা ব্যবহার করতেন না। পুরুষের বেশে তিনি আলখাল্লা এবং পাগড়ি পরে জনসম্মুখে আসতেন। তিনি সভাসদ, আমির-ওমরাহদের রাজ্য শাসন প্রসঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতেন এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে আইন বা নির্দেশ জারি করতেন। তিনি দক্ষ অশ্বারোহী ছিলেন এবং বর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতেন।
তিনি শক্তিশালী তুরস্ক-বংশোদ্ভূত প্রাদেশিক গভর্নরদের চেয়ে দিল্লির সাধারণ জনগণের সমর্থনে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তুর্কিদের একেবারেই পাত্তা দিতেন না তিনি। রাজিয়ার রাজত্বকালে শিয়ারা সুলতানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সেটিও রাজিয়ার কৌশলী দক্ষতার ফলে সফলভাবে দমন করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও অনেক বিদ্রোহ দমন করে টিকে ছিলে রাজিয়া। ১২৪০ সালের এপ্রিলে একদল অভিজাতদের দ্বারা তিনি পদচ্যুত হন। এরপর ইখতিয়ারউদ্দীন আলতুনিয়া নামের একজন বিদ্রোহীকে বিয়ে করেন রাজিয়া। এটি ছিল তার সিংহাসন ফিরে পাওয়ার একটি কৌশল মাত্র। তবে তা আর সম্ভব হয়নি। সে বছরের অক্টোবরে তার সৎ ভাই মুইজউদ্দিন বাহরামের কাছে পরাজিত হন রাজিয়া। এরপরই তাকে হত্যা করা হয়।
একটি পক্ষ দাবি করেছেন, ১২৪০ পলায়নকালে তার একজন ভৃত্য যে কিনা এই চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাকে খাদ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করে। এই ভৃত্যই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল।
আরেকটি পক্ষ দাবি করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তার শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোষাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিলো। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তাঁর সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন। কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত রাজিয়াকে হত্যা করে এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়।
প্রাচীন দিল্লিতেই রাজিয়ার সমাধি অবস্থিত। চতুর্দশ শতাব্দীর ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন, রাজিয়ার সমাধিটি তীর্থস্থান হয়ে উঠেছে। এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিটির কাছে অনেকেই আশীর্বাদ চাইতে আসতেন। কথিত আছে, রাজিয়ার সমাধিটি তার সৎ ভাই বাহরামই নির্মাণ করেছিলেন। রাজিয়ার পাশেই তার বোন শজিয়ার সমাধি রয়েছে।
আজকের দিনে সুলতান রাজিয়া নিহত হন। ইসলাম ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কয়জন নারী খুব বেশি আলোচিত হন, সুলতান রাজিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম, যিনি শুধুমাত্র নিজ যোগ্যতাবলে ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী সব রাজা, মহারাজা, বাদশাহ আর সম্রাটদের পাশে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছিলেন। আর তাই ভারতবর্ষের শাসকদের তালিকায় আজও তার নামটি নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...