সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঔপনিবেশ শাসন মুক্ত হলেও মানসিক দাসত্বের মোচন হয়নি


ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না' – এই প্রবচনের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। প্রবচনটি যে কেবল আলঙ্কারিক অর্থে ব্যবহৃত হতো সেরকম নয়। বাস্তবিকই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, সাম্রাজ্যের এক অংশে সূর্যাস্ত হয়ে গেলেও আরেক অংশের আকাশে সূর্য ঠিকই অবস্থান করত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য, এবং পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশ জুড়ে এই সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৯১৩ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৩% ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ৪৫ কোটি ৮০ লাখ যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মোট আয়তন ছিল প্রায় ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ বর্গ কি.মি., অর্থাৎপৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় এক চতুর্থাংশ। এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়ার শাসন শুরু হয়। ঠিক এক শতাব্দীর মধ্যে ১৮৫৮ সালে ভারতে আজাদি আন্দোলন ব্যর্থ হবার পর ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হয়। রাণী ভিক্টোরিয়া নিজ হস্তে ভারতের শাসনভার তুলে নেন।
১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে সেই শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু হয়েছিল ১৭৬৯-৭০ এর দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে। এরপর পুরো শাসনকালে নিয়মিত দুর্ভিক্ষ হয়েছে।ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানও হয়েছিল ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে। পক্ষান্তরে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে আর কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি।
পলাশীর যুদ্ধের খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘বাংলার অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ’ শুরু হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নবাবদের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু রাজস্বই নয়, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ পায়। এর বাইরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও নিয়মিত তারা কথিত উপঢৌকন পেতে থাকে। ভারত থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চিত্র উঠে আসে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পলের পর্যালোচনায়। তিনি লিখেছেন, ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন গড়ে তোলা হয়, তখন বিশ্ব জিডিপিতে ব্রিটেনের অবদান ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। যখন ব্রিটিশরাজের শাসন চূড়ায় তখন চিত্র উল্টো। ভারত তখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী দেশ থেকে ‘দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার প্রতীকে’ পরিণত হয়েছে।
বাংলা থেকে লুট করা অর্থ ব্রিটিনে চলে যেত। এর সুবিধাভোগী ছিল ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃত্ব। পলাশী যুদ্ধের পর দেখা গেল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রায় এক–চতুর্থাংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন।যে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশরা দখল করেছিল, সেটি ছিল সম্পদশালী, প্রতিশ্রুতিশীল, বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধ একটি সমাজ; যে কারণে মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরুতে আগ্রহী ছিল। ১৬০০ সালে, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ব্রিটেন উৎপাদন করছিল বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র ১.৮ শতাংশ। অন্যদিকে ভারত উৎপাদন করছিল ২৩ শতাংশ, যা ১৭০০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ শতাংশে। ১৯৪০ সাল নাগাদ, রাজশাসনের প্রায় দুই শতক পর, ব্রিটেন উৎপাদন করছিল বৈশ্বিক জিডিপির ১০ শতাংশ। অথচ ভারত ততদিনে পরিণত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে। তারা তখন সর্বস্বান্ত, ক্ষুধার তাড়নায় ধুঁকছে। তারা পরিণত হয়েছে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের সমার্থক শব্দে।
ব্রিটিশরা যখন ভারত ছাড়ে, তারা রেখে যায় এমন একটি সমাজব্যবস্থা, যার শিক্ষার হার ১৬ শতাংশ, গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ২৭ বছর, কার্যত কোনো স্থানীয় শিল্পব্যবস্থা নেই, এবং ৯০ শতাংশ মানুষ বাস করছে এমন একটি রেখার নিচে, আজকের দিনে আমরা যাকে বলি 'দারিদ্র্যের সীমা'।
ছয় মহাদেশ শাসনকারী ব্রিটিশরা বর্তমানে ইউরোপীয় মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের সন্নিকটে অবস্থিত একটি স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্রের বাসিন্দা। রাষ্ট্রটি চারটি সাংবিধানিক রাষ্ট্রের (ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ড) সমন্বয়ে গঠিত। আয়তন মাত্র ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৯৫ বর্গকিলোমিটার।জনসংখ্যা ৬ কোটি ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ১৬ জন।
ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর বেশিরভাগ দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর পরও ১৪টি কমনওয়েলথ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে এখনো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ছিলেন।গত বছরের নভেম্বর মাস রানিকে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে পুরোপুরি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় বার্বাডোস। আরও অনেক দেশেই এরকম দাবি উঠেছে।
এদিকে কমনওয়েলথ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার প্রতীক।কমনওয়েলথে ব্রিটিশরা ছাড়াও আরও ৫৩টি দেশ রয়েছে। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মানুষ এই দেশগুলোয় বসবাস করে, যা এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে লন্ডন থেকেই শাসন করা হতো।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

মো.আবু রায়হানঃ আজ ২০ রমজান ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের ১৪৩৩ তম বার্ষিকী।আজ থেকে ১৪৩৩ বছর আগে হিজরতের ৮ম বছরে ২০ রমজান তথা ৬৩০ খৃস্টাব্দে রাসুল (সা.) মক্কা বিজয় করেন। ইতিহাসে এই ঘটনা মক্কা বিজয় বা ফতেহ মক্কা নামে খ্যাত।২০ রমজান শুধু মক্কা বিজয়ই হয়নি বরং প্রিয় নবি স্বমহিমায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন।তাই ২০ রমজান ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে।শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী হলো মক্কা বিজয়ের এ ঘটনা। পৃথিবীর আরম্ভ থেকে আজ পর্যন্ত যত যুদ্ধ ,বিজয় অভিযান, হয়েছে এসব যুদ্ধ ও অভিযানে একদল বিজয়ী হয়েছে আরেক দল পরাজয়কে বরণ করেছে। এসব যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন দিগ্বিজয়ী ইতিহাসের মহানায়কেরা। তাদের মধ্যে হিটলার,আলেকজেন্ডার,আর নেপোলিয়ান বেনাপোর্টের বিজয় অভিযানগুলো ছিল রক্তপাতের ইতিহাস,মানুষের রক্তে হাত রঞ্জিত হবার ইতিহাস।একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়। ঐতিহাসিকদের মতে মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় যদিও আল কুরআনে হুদাইবি য়ার সন্ধিকেই ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয় বলে উল্লেখ করা হয়েছ...