মানজিকার্টের যুদ্ধে বন্দি বাইজেন্টাইন সম্রাট



২৬ আগস্ট ১০৭১ খ্রিস্টাব্দ, সেলজুক সুলতান আলপ আরসালান মানজিকার্টের যুদ্ধে পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করান বাইজেন্টাইন সম্রাট রোমানোসকে।
Alp Arslan defeated Eastern Roman Empire in battle of Manzikert 1071 and opened Anatolia for Sunni Turks. He is also the only Muslim commander in the entire history who was not only able to defeat but also imprison a Roman Emperor .
সুলতান মুহাম্মদ বিন দাউদ, ইতিহাসে যিনি পরিচিত আলপ আরসালান। তিনি সেলজুক রাজবংশের তৃতীয় সুলতান এবং সেলজুকের প্রপৌত্র। তার সময় থেকেই সেলজুক বংশ রাজবংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার সামরিক দক্ষতা, বীরত্ব এবং লড়াইয়ে পারদর্শিতার জন্য তিনি আলপ আরসালান উপাধি লাভ করেন।
বাইজেন্টাইন সম্রাট ৪র্থ রোমানোস ডিয়োজেনেস ১০৭১ সালে বিশাল এক বাহিনী নিয়ে আরসালানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন।যুদ্ধে সেলজুক বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল বাইজান্টাইনদের তুলনায় খুবই নগণ্য। বাইজান্টাইন বাহিনীতে ছিল ফ্রেঞ্চ, গ্রীক, রাশানসহ বিভিন্ন জাতির ২ লক্ষাধিক সেনা, ওদিকে সেলজুক বাহিনীতে সৈন্যসংখা মাত্র ১৫ হাজারের কাছাকাছি।ভন লেকের উত্তর দিকের মুরাট নদীর তীরবর্তী মানযিকার্টে আলপ আরসালান ও রোমানোসের বাহিনী মুখোমুখি হয়। সুলতান আল্প আরসালান সন্ধির প্রস্তাব করলেও সম্রাট রোমানোস তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে দুই বাহিনীর মধ্যে লড়াই শুরু হয়। এই যুদ্ধ ইতিহাসে মানযিকার্টের যুদ্ধ বলে পরিচিত।
যুদ্ধের আগে দূতের মাধ্যমে পত্র চালাচালি হতে থাকে সুলতান আলপ আরসালান ও সম্রাট রোমানোসের মাঝে। সেলজুক সুলতান চাচ্ছিলেন যুদ্ধবিরতি, ওদিকে বাইজান্টাইন সুলতান চাচ্ছিলেন মুসলিমদের হাতে বাইজেন্টাইনদের পরাজয়ের শোধ তুলতে।বার্তা চালাচালির সর্বশেষ পর্যায়ে রোমানোস দম্ভ সহকারে আলপ আরসালানকে লিখে পাঠান,
আমি এমন এক বাহিনী নিয়ে এসেছি, আপনি যার প্রতিরোধ করতে পারবেন না। তাই স্বেচ্ছায় আমার আনুগত্য মেনে নিন।
সৈন্যসংখ্যার স্বল্পতা থাকলেও আলপ আরসালান তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত ছিলেন না, বরং সবকিছু জেনেই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন তিনি, সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এই যুদ্ধের প্রকৃত মর্ম সম্পর্কে। তাই তো এমন অহমিকাপূর্ণ জবাব পেয়ে তিনিও বীরের মতোই দূতকে বললেন,
তোমার মনিবকে বলো, আমার রব আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন যেন আমি তার প্রশংসা করতে পারি। আমার রব তোমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন যেন তোমরা মুসলিমদের খাবার রান্না করো।
উত্তপ্ত এই বাক্য বিনিময়ের পর যুদ্ধ ছিল অবধারিত, এবং সেটা হয়েও যায়। যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় বাইজান্টাইন বাহিনী, সেলজুকদের হাতে ধরা পড়ে তাদের সম্রাট। সৈন্যসংখ্যার এই আধিক্যও তাদের পরাজয় ঠেকাতে পারেনি।
বাইজেন্টাইন বাহিনীর কুমান সৈনিকরা, যারা মূলত ভাড়াটে সৈন্য ছিল, তৎক্ষণাৎ দলত্যাগ করে সেলজুক তুর্কিদের পক্ষে যোগ দেয়। কুমানদের দলত্যাগের ঘটনায় প্ররোচিত হয়ে ফ্রাঙ্ক ও নর্মানরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে।ফলে বাইজেন্টাইনরা যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়। সম্রাট রোমানোসকে বন্দী অবস্থায় আল্প আরসালানের সামনে আনা হয়।
আল্প আরসালান তার সাথে সদয় আচরণ করেন। নিম্নোক্ত আলাপ তাদের মধ্যে হয়েছিল বলে কথিত আছে আল্প আরসালান: যদি আমাকে আপনার সামনে বন্দী হিসেবে আনা হত তবে আপনি কী করতেন? রোমানোস: হয়ত আমি আপনাকে হত্যা করতাম অথবা কন্সটান্টিনোপলের রাস্তায় প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতাম। আল্প আরসালান: আমার শাস্তি এর চেয়েও কঠিন। আমি আপনাকে ক্ষমা করেলাম এবং আপনি মুক্ত।
আলপ আরসালানের এই বিজয় নিকট এশিয়ায় সেলজুক তুর্কি ও সুন্নি মুসলিমদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠে। যদিও পরবর্তী চার শতাব্দী পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য টিকে ছিল এবং ক্রুসেডারদের কারণে মুসলিমরা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, মানযিকার্টের যুদ্ধ আনাতোলিয়ায় তুর্কিদের অগ্রযাত্রার পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠে। এডওয়ার্ড গিবনসহ অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তার মতে মানযিকার্টের পরাজয় হল পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা। বাইযান্টাইনদের কাছ থেকে আনাতোলিয়া অধিকারের ঘটনা ক্রুসেডের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।
গুরুত্বের বিবেচনায় মানজিকার্টের যুদ্ধকে তুলনা করা ইয়ারমুক যুদ্ধের সাথে। অনেক ঐতিহাসিকগণ দ্বিতীয় ইয়ারমুক যুদ্ধ বলেন। এরকম দাবি মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। ইয়ারমুক যুদ্ধে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শাম অঞ্চলের এলাকাগুলো হারিয়েছিল, যা আর কোনোদিনই ফেরত পায়নি। মানজিকার্ট যুদ্ধে হাতছাড়া হয় আনাতোলিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যার ফলে গোটা এশিয়া মাইনর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তুর্কীরা। তুর্কীরা মানজিকার্টের যুদ্ধে পরাজিত হলে সেদিনই সেলজুকদের নাম-নিশানা মুছে যেত। আর তেমন কিছু হলে অঘুজ তুর্কী গোত্রগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
"The Battle of Malazgirt is one of the most crucial incidents and a turning point in the world history,” wrote Professor Mukrimin Halil Yinanc, one of the top Turkish historians on the subject of the Seljuks, in his reference book, The History of Turkey, The Age of the Seljuks)
২৬ আগস্টকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে পালন করা হয় তুরস্কে।
১০৭২ সালের ২৫ নভেম্ব আরসালান মৃত্যু বরণ করেন। মার্ভে তার পিতা চাঘরাই বেগের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিতে লেখা রয়েছে: “যারা সুলতান আল্প আরসালান বেগ'র আকাশসম জাকজমক দেখেছ, দেখ, তিনি এখন কালো মাটির নিচে শায়িত...”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল