সুলতান সুলাইমান
সুলতান সুলাইমান ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে একজন বিশিষ্ট সাম্রাজ্যাধিপতি হিসেবে স্থান লাভ করেন, যার শাসনামলে উসমানীয় খেলাফতের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
তিনি ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের দশম এবং সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী শাসনরত প্রভাবশালী সুলতান, যিনি ১৫২০ সাল থেকে ১৫৬৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য শাসন করেন।সুলতান সুলাইমানের সেনাবাহিনী পূর্ণ রোমান সাম্রাজ্য এবং সুবিশাল হাঙ্গেরির পতন ঘটায়। সুলতান সুলাইমান পারস্যের সাফাভি রাজবংশের শাহ প্রথম তাহমাসবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং মধ্য প্রাচ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল দখল করে নেন। তিনি উত্তর আফ্রিকায় আলজেরিয়া ও লিবিয়া সহ বড় বড় অঞ্চলগুলো দখল করেন। তার শাসনামলে তার অধীনস্থ কাপুদান পাশা (নৌ-সেনাপতি) খিজির খাইরুদ্দিন বারবারোসা, স্পেনের অ্যাডমিরাল আন্দ্রে দোরিয়ার নেতৃত্বে সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৫৩৮ সালে প্রিভিজার যুদ্ধে বিজয় লাভ করে। এই নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর পর্যন্ত তাদের আধিপত্য বজায় রাখে।এছাড়াও তার নৌ-বাহিনী তৎকালীন স্পেনের হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া পলায়নরত নির্বাসিত মুসলিম ও ইহুদিদের উদ্ধারকার্য পরিচালনা করেন। সুলতান সুলায়মান ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবেচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান সুলতান।
সুলতান সুলাইমান শিল্পী, ধর্মীয় চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকদের একটি বাহিনীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি ইস্তাম্বুল এবং তাঁর সাম্রাজ্যের অন্যান্য প্রদেশে বিশাল অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প পরিচালনা করেন। মহান স্থপতি মিমার সিনান তাঁর শাসনামলকে গৌরবোজ্জ্বল করেন।
সুলাইমান ফিকাহবিদ আবু হানিফার সমাধি, জেরুজালেম, মক্কা ও মদিনার মসজিদের মতো অনেক ধর্মীয় ভবন পুনরুদ্ধার করেন। তিনি বাগদাদ বিজয়ের পর বিখ্যাত সুফি ওস্তাদ শেখ আব্দুল কাদরী জিলানীর সমাধি নির্মাণেরও নির্দেশ দেন।
১৫৬৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, মহান সুলতান সুলাইমান ইস্তাম্বুল থেকে হাঙ্গেরিতে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে যাত্রা করেন। হাঙ্গেরির সিগেটভারের যুদ্ধে উসমানীয়দের বিজয়ের আগেই তিনি মারা যান।৫৪৫ উজিরে আজম দ্বিতীয় সেলিম এর সিংহাসনে বসার পূর্বে তার মৃত্যু গোপন রেখেছিলেন। অসুস্থ সুলতান সুলাইমান তার ৭২ বছর বয়স হবার দুই মাস আগে তার তাঁবুতে মারা যান। সুলতানের মৃতদেহ দাফনের জন্য ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু তার হৃদপিণ্ড, যকৃত এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সিগেটভারে তারবেকে সমাহিত করা হয়। সুলাইমানের উপরে নির্মিত মাজারটি পবিত্র স্থান এবং তীর্থস্থান হিসাবে বিবেচিত। মৃত্যুর পরবর্তী দশকের মধ্যে মাযারের কাছাকাছি একটি মসজিদ এবং সুফি ধর্মশালা তৈরি করা হয়।
তাঁর শেষ দিনগুলিতে, তিনি তাঁর বেশিরভাগ মনোযোগ শুধু শাসন, আইন প্রণয়ন এবং ধার্মিক জীবনের প্রতি নিবেদিত করেছিলেন। তিনি তাঁর দরবারের জাঁকজমকের জন্য ইউরোপীয়দের কাছে সুলেইমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট নামে, তুরস্কে কানুনি সুলতান নামে এবং আরব বিশ্বে সুলাইমান আল মুহতাশাম নামে পরিচিত।তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের পুরাতন নীতিমালাগুলো পূণরায় সম্পূর্ণরূপে লিপিবদ্ধ করেছিলেন বলে তুরস্কে তাঁকে বলা হয় কানুনি সুলতান। মুসলমানরা তাকে 'কানুনি' (আইনদাতা) বলে ডাকে কারণ তাঁর শাসনের অধীনেই সুলতানি আইন (কানুন) সংকলিত, পদ্ধতিগত এবং ইসলামী আইনের (শরিয়া) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন