মুর্শিদাবাদ নামটি বিলুপ্তির পথে
নবাবের রাজধানী মুর্শিদাবাদ। নবাবের দেশ মুর্শিদাবাদ। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড় অঞ্চলের রাজা শশাঙ্কের রাজধানী মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসূবর্ণ অঞ্চলে ছিল। বাংলার অন্যতম পাল রাজা মহিপালের রাজধানী শহরও সম্ভবত এই জেলায় ছিল।বর্তমানে মুর্শিদাবাদ পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা বিভাগের একটি জেলা। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যভাগে অবস্থিত এই জেলাটি অনেকটা ত্রিভূজের অনুরূপ আকৃতিবিশিষ্ট।এই জেলার উত্তরে মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, দক্ষিণে নদীয়া জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা অবস্থিত ৷১৭১৭ থেকে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার একচ্ছত্র রাজধানী ছিল এই শহর; দেওয়ান নবাব মুর্শিদকুলি খানের নামে নামাঙ্কিত হয়ে পরিচিত হয়েছিল মুর্শিদাবাদ নামে। ৫.৩১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মুর্শিদাবাদে জনসংখ্যা প্রায় ৭১.০২ লক্ষ ।
মুর্শিদাবাদ নামের সঙ্গে জড়িত আছে নবাব মুর্শিদ আলী খাঁ, নবাব আলীবর্দী খাঁ, নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও মোঘল আমলের আরো অন্যান্য নবাব দের নাম ৷নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, জগৎ শেঠ , লর্ড ক্লাইভ,মেহেরুন্নেসা, মির্জাফর আরো অন্যান্যদের ষড়যন্ত্রের নীরব সাক্ষী এই মুর্শিদাবাদ।১৭৫৭ সালে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পলাশীর যুদ্ধের সাক্ষীও ছিল মুর্শিদাবাদ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধের পরে বহু বছর ধরে এখান থেকে রাজত্ব করেছিল। আজও মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে
লুকিয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সম্পদ।
১৫ ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা কার্যকর হয় এবং পরবর্তী দুই দিনের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অংশ ছিল।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত সোমবার সাতটি নতুন জেলা ঘোষণা করেন। তার মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলায় মুর্শিদাবাদ বাদ দিয়ে বহরমপুর জেলা জঙ্গিপুর জেলা ও কান্দি জেলা ঘোষণা করেন।এরমধ্য থেকে হারিয়ে গেল মুর্শিদাবাদ নামটার অস্তিত্ব।
মুর্শিদাবাদ জেলা ভেঙে ৩টি জেলা হওয়ার ঘোষণায় খুশি জেলার একাংশ। কিন্তু জেলা ভাঙলে নাম বদল হয়ে যাবে। তাই ঐতিহাসিক নবাবি আমলের জেলার নাম পরিবর্তনে অখুশি অনেকেই। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদদের একাংশ জেলার নাম পরিবর্তন নিয়ে বিরোধিতায় নেমেছে।
নামগুলো তো এভাবেও দেওয়া যেত উত্তর মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ মুর্শিদাবাদ বা পূর্ব মুর্শিদাবাদ তাতে প্রশাসনিক জটিলতাও কমতো এবং মুর্শিদাবাদ নামটাও রক্ষা পেত । মুর্শিদাবাদ নামটাকে অস্তিত্বহীন করে মুঘল আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলে আসা এক প্রশাসনিক এলাকার অস্তিত্ব ধ্বংস করা হলো। কলকাতারও আগে গোড়াপত্তন হয়েছিল মুর্শিদাবাদের। সেক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদের নামের সঙ্গে জেলার মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে। লোকসংস্কৃতি গবেষক শক্তিনাথ ঝাঁ বলেন, "মুর্শিদাবাদ এক ঐতিহ্যের নাম। ইতিহাসের পীঠস্থান। জেলার নামের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ নাম বাদ পড়লে ইতিহাসকে বিদ্রুপ করা হবে।"একইভাবে ইতিহাসবিদদের মতে, মুর্শিদাবাদ নামের সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে রয়েছে। মুর্শিদাবাদ নাম না থাকলে ইতিহাসকে বিকৃত করা হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন