ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না
হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মানিত কন্যা ফাতেমার (রা.) সন্তান এবং তাদের ফযীলতে বেশকিছু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত তাদের মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা। তাই আমাদেরও হযরত হাসান ও হুসাইনকে (রা.) অন্তর থেকে ভালোবাসি।আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসায় কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি না করে তাদের সর্বোচ্চ ভালোবাসতে হবে। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে কোনো মুসলিমের মৃত্যুতে বিলাপ-উচ্চস্বরে ক্রন্দন করা যাবে না। এটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং একটি পাপের কাজ।মহররম আসার সঙ্গে সঙ্গে হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ওপর মাতম-বিলাপ শুরু করা ও নিজ দেহে ছুরিকাঘাত করা গর্হিত অপরাধ। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘শোকে বিহ্বল হয়ে যে ব্যক্তি গাল চাপড়ায়, কাপড় ছেঁড়ে ও জাহেলি যুগের মতো আচরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৯৭)
তিনি আরও বলেন, মুসিবতে পড়ে বিলাপকারী, মাথা মুণ্ডনকারী এবং কাপড় ও শরীর কর্তনকারীর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে কিয়ামতের দিন খাজলীযুক্ত বা লোহার কাঁটাযুক্ত কোর্তা পড়ানো হবে এবং আলকাতরার প্রলেপ লাগানো পায়জামা পড়ানো হবে। (মুসলিম)
কালো পতাকা উত্তোলন, রাত জাগা, দুলদুল কবর ইত্যাদির আকৃতি বানানো, সাজসজ্জা ও আরাম-আয়েশ ত্যাগ করা, মর্সিয়া করা, পুঁথি পাঠ করা, হালুয়া-রুটির হৈ-হুল্লোড় করা, শোকযাত্রা বের করা, আতশবাজি ও আলোকসজ্জা করা বিদআত। এসবের মধ্যে এমন কাজও রয়েছে, যেগুলোতে শিরকের আশঙ্কা থাকে। অতএব এসব কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। কেউ কেউ আশুরাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কল্পিত ঘটনা ও বিশেষ বিশেষ পন্থায় ইবাদতের উপদেশ দিয়ে থাকেন—যা কোরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। সুতরাং তাও নিন্দনীয় ও বর্জনীয়।
আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন : বিভিন্ন বিপদের দিনকে শোকের দিন বানানো ইসলাম সমর্থন করে না। এটি জাহেলি কাজ। শিয়া সম্প্রদায় আশুরার দিনে এসব করে এ দিনের মর্যাদাবান রোজা ছেড়ে দেয়। (হাকিকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআতি, খণ্ড-১, পৃ. ১৪৮)।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘মহররমের ১০ তারিখ পবিত্র কোরআনকে সাজিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা এবং তা মাথায় চড়িয়ে অলিগলিতে প্রদর্শন করা, তার নিচে গিয়ে মাথা লাগানো, চুমো খাওয়া, ঢাকঢোল পেটানো একেবারেই ভিত্তিহীন কাজ। এর দ্বারা সওয়াবের আশা করা একেবারেই বৃথা।’ (ইমদাদুল ফাতোয়ায়ে : ৫/৩৪৮)
প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেন, ‘হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের দিনটিকে যদি মাতম বা শোক দিবসের জন্য এতই গুরুত্ব দেওয়া হতো, তবে সোমবার দিনটিকে আরো ঘটা করে শোক দিবস হিসেবে পালন করা বেশি বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ, এ দিন মহানবী মুহাম্মদ (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনেই নবীর পর শ্রেষ্ঠ মানব প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।’ (গুনিয়াতুত তালেবিন : ২/৩৮)
আল্লামা রুমি (রহ.) বলেন, ‘হোসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর শাহাদাতের কারণে রাফেজিদের মতো এ দিনটিকে মাতমের জন্য নির্দিষ্ট করে নেওয়া, বস্তুত দুনিয়ায় নিজেদের পুণ্যময় সব কাজ বিনাশ করার নামান্তর।’ (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া : ২/৩৪১-৩৪২)
মারেফুল কোরআন রচয়িতা মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেন, ‘কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলমানের অন্তরকে সব সময় ব্যথিত করে। শুধু ১০ মহররমকে শোকের জন্য বেছে নেওয়া বোকামি বৈ কিছুই নয়।’ (ইমদাদুল মুফতিয়িন : ১/৯৬)
হযরত হোসাইন (রা.)-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র আলী বিন হুসাইন, মুহাম্মাদ এবং জাফর জীবিত ছিলেন। তাদের কেউ হুসাইন (রা.)-এর মৃত্যুতে মাতম করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তারা ছিলেন আমাদের হেদায়েতের ইমাম ও আদর্শ। বিলাপ করা, গাল ও বুকে চপেটাঘাত করা বা এ জাতীয় অন্য কোনো কাজ কখনই ইবাদত হতে পারে না।একজন বিবেকবান মুসলিমের উপর আবশ্যক হচ্ছে সে যে কোনো ধরনের মুসিবতের সময় আল্লাহর নির্দেশিত কথা বলবে।আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাব। (সূরা বাকারা: ১৫৬) কারবালার মূল চেতনা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে সাময়িক আঘাত এলেও চূড়ান্ত বিজয় অবধারিত। এটাই মহররমের শিক্ষা। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন