সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাগদাদ নগরীর ইতিহাস



আব্বাসি খেলাফত মোট ৫২৫ বছর স্থায়ী ছিল। এই দীর্ঘ সময় ৩৭ জন খলিফা খেলাফতের মসনদে বসেন। খলিফা আল মনসুর ছিলেন দ্বিতীয় আব্বাসি খলিফা।

আল মনসুর ইরাকের তাইগ্রিস নদীর পশ্চিম তীরে প্রাক-ইসলামী গ্রাম বাগদাদে ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে এই ঐতিহাসিক নগরটি নির্মাণ শুরু করেন। ৩০ জুলাই ৭৬২ সালে খলিফা আল-মনসুর শহরটি নির্মাণের অনুমোদন দেন। এর নির্মাণকাজ শেষ হতে প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল। শহরের পরিকল্পনা তৈরির জন্য মনসুর সারাবিশ্ব থেকে প্রকৌশলী, সমীক্ষক এবং শিল্প নির্মাতাদের একত্রিত করেন। ১০ লক্ষাধিক নির্মাণ কর্মী পরিকল্পনাটি জরিপ করতে এসেছিলেন; নগরীর ভবন তৈরি শুরু করার জন্য অনেককে বেতন দেওয়া হয়েছিল।
ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর তথ্যানুসারে এক লাখ লোকের অবিরাম পরিশ্রমের ফলে এই সময়ের মধ্যে এত বিশাল একটি নগর নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। শহরটি নির্মাণে ৪০ লাখ দিরহাম খরচ হয়েছিল।আল মনসুর যখন খেলাফতের রাজধানী হিসেবে বাগদাদকে নির্বাচন করেন তখন বাগদাদ ছোট একটি উপ-শহরের মতো ছিল। মনসুর এই স্থানটিকে এতটাই পছন্দ করেছিলেন যে তিনি বলেন: "এটি বাস্তবিকই সেই নগর, যা আমি স্থাপন করি. যেখানে আমি বাস করি এবং যেখানে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা রাজত্ব করবে"।
বাগদাদ পূর্বে ছিল বিশ্বখ্যাত ন্যায়পরায়ণ পারস্য শাসক নওশেরোয়ার রাজধানী। তখন শহরটি খুব জাঁকজমক ছিল কিন্তু পরবর্তীতকালে আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে।
বাগদাদ ফারসি শব্দ। ‘বাগ’ অর্থ বাগান আর ‘দাদ’ অর্থ ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা। ঐতিহাসিকদের মতে, নওশেরোয়া শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি বাগান তৈরি করেন। যা পরবর্তীকালে বাগদাদ নামে প্রসিদ্ধি পায় এবং রাজধানী ঘোষণা করা হয়।সব অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য উপযোগী। চারপাশে ছিল গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রদেশ। যথা- খোরাসান,শাম,বসরা ও কুফা। ফলে বাগদাদ ছিল আরব-অনারব,প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনস্থল।
খলিফা আবু জাফর মনসুর যখন বাগদাদ নগরীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তখন তিনি কুরআনের এই আয়াত পাঠ করেন,‘নিশ্চয় সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি মহান আল্লাহতায়ালা। তিনি তার বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করে থাকেন।’।
প্রথম শহরের নকশা ঠিক করা হয়। মাটির নিচে ভিত্তির প্রশস্থতা ৫০ হাত আর মাটির উপরে ২০ হাত প্রশস্থ প্রাচীর তৈরি করা হয়।
বৃত্তাকৃতি এই শহরটি তিন স্তরে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এক প্রাচীর থেকে অন্য প্রাচীরের মধ্যবর্তী অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছিল। এই ফাঁকা অংশকে বলা হয় ফসিল। ঐতিহাসিক তাবারি ও রাবাহর তথ্যানুসারে এই নগরের বহিঃপ্রাচীরের পরিধি ছিল ১৬ হাজার হাত। বহিঃপ্রাচীরের ৬০ হাত অভ্যন্তরে শহরের প্রধান প্রাচীর নির্মিত হয়েছিল, যার উচ্চতা ছিল ৩৫ হাত। বহিঃপ্রাচীরের চারপাশ পরিখা দ্বারা বেষ্টিত ছিল। বহির্দেয়ালের চারদিকে চারটি বৃহদাকৃতির দরজা ছিল।
শহরবেষ্টিত প্রাচীরে চার প্রদেশের নামে চারটি বাব (দরজা) রাখা হয়। বাবুল খোরাসান, বাবুশ শাম,বাবুল কুফা এবং বাবুল বসরা। এক দরজা থেকে অন্য দরজার দূরত্ব রাখা হয় এক মাইল।
শহরের মধ্যে শাহী প্রাসাদ, জামে মসজিদ, কসরুজ জাহাব,কসরুল খুলদ প্রভৃতি দৃষ্টিনন্দন, শাঁনদার স্থাপত্য এবং সৌধ নির্মাণ করা হয়। ‘কুব্বাতুল খাজরা’ নামে ৮০ গজ উচ্চতার গম্বুজটি ছিল মনোমুগ্ধকর ও চিত্তাকর্ষক স্থাপনা।
শুরুতে শহরটির নামকরণ করা হয়েছিল খলিফার নামানুসারে 'মদিনাত আল-মনসুর'।শহর নির্মাণ শেষ হলে এর নামকরণ করা হয় ‘মাদীনাতুস সালাম’। তবে এই নাম জনসাধারণের কাছে প্রসিদ্ধি পায়নি, শুধু সরকারি রেজিস্ট্রারে ব্যবহৃত হতে থাকে।নগরটি বৃত্তাকৃতি ভূমি নকশায় নির্মিত হওয়ায় একে 'মদিনাত আল-মুদাওয়ারা' নামেও অভিহিত করা হতো।
মনসুরের পরবর্তী খলিফা আল মাহদি এসে বাগদাদের সম্প্রসারণ করেন। দজলা নদীর পূর্ব তীরে নতুন করে শহরকে ঢেলে সাজানো হয়। দজলা নদী বাগদাদ শহরের মধ্যে চলে আসে। ফলে শহরটি আরও চিত্তাকর্ষক ও নয়নাভিরাম হয়ে উঠে।
সময়ের তালে তালে বাগদাদ বিস্ময়কর উন্নতি করতে থাকে। খলিফা,আমির-উমরা এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের নিত্যনতুন রুচির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রূপ ফুটে উঠে।
আল্লামা শিবলী নুমানি বলেন, এককালে বাগদাদে ত্রিশ হাজার মসজিদ আর দশ হাজার হাম্মামখানা ছিল। এবং বাগদাদে ৮৬০ জন ডাক্তার প্র্যাকটিস করতেন। খলিফা হারুন-অর-রশীদের সময়ই নগরীর জনসংখ্যা দশ লাখের চেয়ে বেশি ছিল।
শহরটি বিজ্ঞান, চিকিৎসা, দর্শন এবং শিক্ষার একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়, বিশেষত দ্বিতীয় খলিফা আল মনসুরের অধীনে আব্বাসীয় অনুবাদ আন্দোলনের সূচনা হয় এবং সপ্তম খলিফা আল-মামুনের অধীনে এটি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠে। শিক্ষাস্তরে বাইতুল হিকমাহ বা "হাউস অফ উইজডম" সর্বাধিক পরিচিত ছিল এবং নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম বাছাইকৃত বই-এর সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত ছিল।
মুসলিম সভ্যতার এই প্রাচীন লীলাভূমি খুব বেশি দিন এই ধরণীর বুকে টিকে থাকেনি। ১২৫৮ সালে দুর্ধর্ষ মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান আক্রমণ করে এই শহরটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। ধারণা করা হয় বাগদাদে প্রায় ২ থেকে ১০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল যার মূল টার্গেট ছিল বাগদাদের মুসলমানরা। আসলে পরিস্থিতির নারকীয়তা এতই ভয়াবহ ছিল যে সেই ইতিহাস যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করার মত কোন সুস্থ মানুষ সেখানে জীবিত ছিলেন না। বিপুল পরিমাণ মানুষের রক্ত ও বইয়ের কালির দরুণ কিছুদিনের জন্য বদলে গিয়েছিল দজলা ও ফোরাতে পানির রং। ১৪০১ সালে মধ্য এশীয় তুর্কি বিজেতা তৈমুর লং বাগদাদে আবারও ধ্বংসযজ্ঞ চালান। ১৫৩৪ সালে উসমানীয়রা (অটোমান তুর্কিরা) বাগদাদ দখল করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসার আগ পর্যন্ত (১৯১৭) বাগদাদ উসমানীয় শাসনের অধীনে ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ সালে ইরাককে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এরপর বাগদাদ ধীরে ধীরে আরব সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে তার আগের কিছু খ্যাতি ফিরে পায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...