ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটালো যে চুক্তি
লুজান চুক্তি হল ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত এমন একটি শান্তি চুক্তি যার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে বর্তমান তুরস্কের সীমানা। অর্থাৎ আধুনিক তুরস্কের জন্ম এই চুক্তির মাধ্যমে। লুজান চুক্তির আগে, ১৯২০ সালে ‘সেভের্সের সন্ধি’ সমাপ্ত করা হয়েছিল, যার আওতায় ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অ-তুর্কি রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে তুর্কিরা এই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে ১৯২২-১৯২৩ যুদ্ধের দুর্দান্ত জয় অর্জন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়।
তখন ১৯২২ সাল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে।কিন্তু ইউরোপর কিছু কিছু জায়গায় তখনও সংঘাত চলছে। বিশাল ওসমানীয় সম্রাজ্য ভেঙে খান খান।
পশ্চিমাদের মদদে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকায় ওসমানীয়ওদের অধীন থেকে বেড়িয়ে গঠিত হয়েছে প্রায় ৪৫ টির মত নতুন রাষ্ট্র।
ইস্তান্বুলে উসমানীয়দের শেষ সুলতান কার্যত নিষ্ক্রিয়, ক্ষমতাহীন। মিত্রশক্তিদের হাত থেকে শেষ ভূমিটুকু রক্ষায় মরণপণ লড়াই করছেন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে একদল তুর্কি সেনা। পরাশক্তির বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতাও পেয়েছেন তাঁরা। গ্রীকদেরকেও তাড়িয়ে দিয়েছেন নিজেদের ভূখণ্ড থেকে।
২৮ অক্টোবর ১৯২২ সাল। মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে তুর্কিদের কাছে দাওয়াত আসে বৈঠকে বসার। আহ্বান আসে যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য,একটি শান্তি চুক্তির জন্য আলোচনায় বসার। একই বৈঠকে দাওয়াত দেওয়া হয় আঙ্কারায় কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুর্কি সরকারেকে এবং ইস্তানবুলে নিভু নিভু সালতানাতের সুলতানকেও। কিন্তু এই দাওয়াত আসার তিন দিনের মাথায় আতাতুর্ক সালতানাতকে বিলুপ্ত ঘোষণা করলে শান্তি চুক্তির বৈঠকে শুধুমাত্র তার নেতৃত্বাধীন সরকারের যোগ দেওয়ার পথ উম্মুক্ত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তকারী চূড়ান্ত চুক্তি হিসেবে পরিচিত ১৯২৩ সালের লুজান চুক্তিতে একদিকে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধিরা এবং অন্য দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরা ছিলেন। সাত মাসের সম্মেলনের পরে ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে স্বাক্ষরিত হয়েছিল বিধায় এর নাম হয় লুজান চুক্তি।
চুক্তিতে তুরস্কের আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানার স্বীকৃতি দেয়া হয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, তুরস্ক তার আগের আরব প্রদেশগুলোর ওপর কোনো দাবি জানাবে না এবং সাইপ্রাসে ব্রিটিশদের দখল এবং ডডেকানিজের ওপর ইতালীয় অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। অন্য দিকে মিত্ররা তাদের তুরস্কের কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করবে। সাথে সাথে তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বত্ব ত্যাগ করবে। আর তুরস্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করার দাবি ত্যাগ করবে মিত্র শক্তি এবং তুরস্কের আর্থিক বা সশস্ত্র বাহিনীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ চাপাবে না। এজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের মধ্যে বসফরাস প্রণালীতে জাহাজ চলাচলে কোনো ফি নিতে পারবে না তুরস্ক।
লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ওসমানীয় খেলাফতের ৬০০ বছরের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ওসমানী সালতানাতের সব উত্তরাধিকাদেরকে নির্বাসিত করা হয়, কাউকে গুপ্ত হত্যা করা হয়, অনেককে নিখোঁজ করা হয়। তাদের সম্পদ বাজয়াপ্ত করা হয়। এই ভাবে খিলাফতের শেষ চিহ্ন পর্যন্ত মুছে ফেলা হয় তুরস্ক থেকে।
কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপ আমেরিকার তাবেদার সেক্যুলার রাষ্ট্র। নিষিদ্ধ করা হয় আরবী চর্চা, বন্ধ করা হয় হাজারো মাদ্রাসা, মসজিদে মসজিদে আজান নিষিদ্ধ করা হয়, হত্যা করা হয় বহু ইমাম, মুয়াজ্জিন, ইসলামী স্কলার এবং আলেমকে। ওসমানী সালতানাতে মূলত দুটি ভাষা প্রচলিত ছিল একটি আরবী অপরটির ফারসি। সাম্রাজ্যের বর্ণমালাকে আবজাদ বলা হতো, যা ওসমানী সাম্রাজ্যের ভাষা বলে পরিচিত ছিল। তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষার পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রচলন করা হয় ল্যাটিন ভাষার। এই ভাবে রাতারাতি একটি জাতিকে ফেলে দেয়া হয় অক্ষরজ্ঞানহীন, পরিচয়হীন একটি অন্ধকার কুপে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন