নরবলি ও হযরত শাহ মখদুম (রহ.)



নরবলি হলো দেবতাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ প্রাপ্তির আশায় কিংবা ক্রুদ্ধ দেবতাকে শান্ত করার লক্ষ্যে মানুষ হত্যা। এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয় সংস্কার যা বিভিন্ন সভ্যতায় অঙ্গীভূত ছিল কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় অবসিত হয়েছে।পৃথিবীর প্রধান ধর্মসমূহে নরহত্যা তথা নরবলির বিধান নেই, বরং নরহত্যা নিষিদ্ধ। নরহত্যার সঙ্গে নরবলি'র পার্থক্য হলো নরবলি সামাজিকভাবে অনুমোদিত মানুষ হত্যা যার উদ্দেশ্য দেবতাদের সন্তুষ্টি অর্জ্জন।
এই নরবলি প্রথা শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ছিল৷ তবে অতীতে৷ প্রাচীন গ্রিসে দেবতা জিউসের সামনে শিশুবলি দেবার প্রমাণ পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা৷ খরস্রোতা নদীর ওপর বাঁধ ও সেতু নির্মাণের আগে কিংবা ঘরবাড়ি তৈরির আগে অশুভশক্তিকে তুষ্ট করতে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল জাপানে৷মিশরে ফারাওদের কবরের সঙ্গে বেশ কিছু ক্রীতদাসকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হতো৷ দক্ষিণ এশিয়াতেও বড় বড় রাজা-মহারাজা বা জমিদারেরা বিশেষ কামনা পূরণের জন্য নরবলি দিত৷ নরমুণ্ড মালিনী, জিবে রক্তধারা, হাতে খাঁড়া নিয়ে দেবি কালীর বা দেবি চামুন্ডার বিগ্রহে অথবা বেদীতে নরবলি ছিল মর্যাদার প্রতীক৷ কালক্রমে এ প্রথাই মোষবলিতে বা পাঁঠা বলিতে নেমে আসে৷ হিন্দু পুরাণেও অশ্বমেধ যজ্ঞের মতো নরমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে৷
রাজশাহীর পদ্মার তীরে মহাকালগড়ে ধীবর সম্প্রদায় বা জেলেদের বড় অঞ্চল ছিল। রাজশাহী বা মহাকালগড় ছিল এক সমৃদ্ধ জনবসতি যেখানে সব ধরনের লোক বাস করত।
নদীর ধারে ছিল এক বিশাল কালী মন্দির যেখানে পূজা দিতে ভক্তদের সমাগম লেগেই থাকত। ভক্তদের বিশ্বাস মৃত্যু, কাল ও রূপান্তর নিয়ন্ত্রণ করেন সনাতন এই দেবী।
এদিকে রাজার ঘরে দুই রাজপুত্র। তাদের একজন হলেন চাঁদ। রাজার এই পুত্ররা নিষ্ঠুর সব আচার পালন করতেন, রাজবংশে যেমনটা প্রায়ই ঘটে। কালী মন্দিরে তারা নরবলির প্রচলন করেন। আধ্যাত্মিক পুণ্যলাভের উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়ার জন্য স্থাপন করা হয় বিশাল এক মঞ্চ।
অমাবস্যার রাতে সেখানে ধুমধাম করে আয়োজন করা হয় নরবলির। কালী পূজা দিতে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। গান, ছন্দ আর ধূপধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক ভারি হয়ে উঠে।
রাত বাড়লে দেখা যায় পেছনে হাত বাঁধা হতভাগা একজনকে কালো রুমালের টুকরায় চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মঞ্চের দিকে। ঢাকঢোলের আওয়াজ তীব্র হতে শোনা যায়। জ্বলন্ত ধূপ আর লাল গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো বেদীর দিকে জোর করে টেনে নিয়ে তাকে যূপকাষ্ঠের ওপর ফেলা হয়। তার মাথা তখন দুই স্তম্ভের মাঝে। দুজন লোক পেছনে হাত চেপে ধরে আছে।
দ্রুততালে বাজছে ঢাক। হাজার হাজার কাঁচ ভাঙার শব্দে বেজে উঠছে করতাল। জ্বলন্ত মশালের হলদে শিখায় ভক্তদের শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম চকচক করছে। ঢাকের তালে উন্মাদের মতো তারাও দুলছে।
সেই সময় চকচকে ধারালো খড়গ হাতে উপস্থিত জল্লাদ। তন্ত্রসাধকরা সবাই উচ্চস্বরে মন্ত্র পাঠ করতে শুরু করেছে। জল্লাদ দুই হাতে খড়গটি খুব উঁচুতে তুলে নিয়েছে। ঠিক এরপরই চোখের পলকে দ্রুতবেগে তা নামিয়ে আনা হলো। খুব পরিষ্কারভাবে ধর থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। মাংস কিংবা হাড় কাটতে যে ধরনের শব্দ শোনার কথা তা পাওয়া গেল না। কিন্তু মাথাটি ভূপতিত হওয়ার সঙ্গে একটা ভোঁতা শব্দের সঙ্গে রক্তের উজ্জ্বল ধারা দেখতে পেল ভক্তরা। উল্লাসে ফেটে পড়ল উন্মত্ত মানুষের দল।
একদিন শাহ মখদুমের অনুসারী ইরাকি ইসলাম প্রচারক শাহ তুরকান শহীদ বাগদাদ থেকে রাজশাহী আসেন। তখন ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ। তিনি এখানে ইসলামের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন।উন্নত চরিত্র আর মহানুভবতার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই লোকজন দলে দলে ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আসা শুরু করে। ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা এতই বাড়তে থাকে যে বিষয়টি শাসকচক্রের নজরে চলে আসে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তান্ত্রিক রাজপুত্র অংশু দেও চাঁদবন্দী বর্মাভোজ ও অংশু দেও খেরজুরচাঁদ খড়গ বর্মা গুজ্জভোজের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন শাহ তুরকান। রাজকুমারদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।তাকে রাজশাহী শহরে দরগাপাড়া এলাকায় সমাহিত করা হয়।
শাহ মখদুম তখন নোয়াখালীতে ইসলাম প্রচারে ব্যস্ত। শাহ তুরকামকে হত্যার খবর পেয়ে তিনি তান্ত্রিক রাজাদের শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিজ বাহিনী নিয়ে শাহ মখদুম রাজশাহীতে এসে এখানকার রাজাদের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ করেন। প্রতিবারই তিনি তাদের পরাজিত করেন। সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় রাজশাহীর ঘোড়ামারায়। ঘোড়ামারা নামটি এসেছে এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যেখানে শত শত ঘোড়া নিহত হয়েছিল।
পরাজিত রাজারা ইসলাম গ্রহণের পর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নরবলির প্রথাও শেষ হয়ে যায়। তবে শাহ মখদুমের অনুসারীরা বলির বেদীটি সংরক্ষণ করে। মাজারে গেলে আজও দেখা মিলবে এই বেদীর।
দশ ফুট বাই দশ ফুট বর্গাকার জায়াগাটির ভেতর দুটি ছোট পাথরের স্তম্ভ। এখানেই মানুষের মাথা পেতে বলি উৎসর্গ দেওয়া হতো। যূপকাষ্ঠের নিচে একটি ছোট গর্ত আছে যেখান থেকে শিরশ্ছেদের পর জমে থাকা রক্ত চলে যেত নর্দমায়। পাশেই আরেকটি বাটির মতো বড় গর্ত। কাটা মাথাটি এখানেই রাখা হতো।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল