সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঐতিহ্য ভেঙ্গে পহেলা হিজরি কাবার গিলাফ পরিবর্তন




কাবা শরীফের গিলাফ একটি বস্ত্রখণ্ড যা দ্বারা কাবাকে আচ্ছাদিত করে রাখা হয়।ঐতিহাসিক সূত্রে বলা হয়েছে, হজরত ইসমাঈল (আ.) প্রথম পবিত্র কাবাঘরকে গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদন করেন।ভিন্ন আরেকটি বর্ণনায় আছে, মহানবীর (সা.) পূর্বপুরুষ আদনান ইবনে আইদ পবিত্র কাবাঘরকে প্রথম গিলাফ দিয়ে আচ্ছাদিত করেন।তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, হিমিয়ারের রাজা তুব্বা আবু কবর আসাদই পবিত্র কাবাঘর গিলাফের মাধ্যমে আচ্ছাদনকারী প্রথম ব্যক্তি। মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মাদ (সা.) এবং হযরত আবু বকর (রা.) কাবা শরিফে গিলাফ পরিয়ে দেন। এরপর থেকে মুসলিম খলিফা এবং শাসকেরা এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
এছাড়াও নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাবা শরিফের গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করেন আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের জননী নুতাইলা। মক্কা বিজয়ের পর রাসুলুল্লাহ (সা) কাবাকে লাল ও সাদা কাপড়ে ঢেকে দেন।পরে বিভিন্ন সময়ে সাদা রংয়ের গিলাফ, লাল গিলাফ, হলুদ গিলাফ ও সবুজ গিলাফ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কালো গিলাফ।যদিও গিলাফ নিয়ে এ সব তথ্য সম্পর্কে ভিন্নমতও আছে।১৯৬২ সাল পর্যন্ত কাবাঘরের গিলাফ মিসর থেকে আসত। মাঝে ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ব্যবহূত কাবার গিলাফ সৌদি আরবের মক্কায় তৈরি হয়েছিল। ১৯৩৯ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত মিসর ফের সেই দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমানে সৌদি আরবে তৈরি হওয়া এই গিলাফও মিসরের অনুকরণে তৈরি হচ্ছে।
কাবার গিলাফ এবারের ঈদ উল আযহার প্রথম দিনেই দুই পবিত্র মসজিদের পরিচালনা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।এই কর্তৃপক্ষের প্রধান শেষ আব্দুল রহমান আল সুদাইসের নেতৃত্বে দেড়শরও বেশি ব্যক্তি গিলাফ পরিবর্তনের কাজে অংশ নেয়ার কথা।
এতদিন এটি ঈদ উল আযহার আগে হজ্বের মূল আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার দিন করা হতো। কিন্তু এবার হজ্বের সময়ে ঐতিহ্য অনুযায়ী অর্থাৎ নয় জিলহজ তারিখে গিলাফ পরিবর্তন করা হয়নি। এবার রেওয়াজের ব্যতিক্রম করা হচ্ছে কারণ সৌদি সরকার হিজরি সনকে গুরুত্ব দিয়ে গিলাফ পরিবর্তন করার কথা বলেছে।
দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়া' কাবার গিলাফ প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠান।
১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এক লাখ বর্গমিটারের এই কমপ্লেক্স একসময় 'কিসওয়া ফ্যাক্টরি' নামে পরিচিত ছিল। পরে ২০১৭ সালে রাজকীয় ডিক্রির মাধ্যমে এই নাম পরিবর্তন করে কমপ্লেক্সটির ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়।
মোট পাঁচ টুকরা গিলাফ বানানো হয়। চার টুকরা চারদিকে এবং পঞ্চম টুকরাটি কাবাঘরের দরজায় লাগানো হয়। টুকরাগুলো মজবুতভাবে সেলাইযুক্ত। প্রতিবছর দুইটি করে (একটি সতর্কতামূলক) গিলাফ তৈরি করা হয়। হাতে তৈরি করতে সময় লাগে আট থেকে নয় মাস। অন্যটি মেশিনে মাত্র এক মাসে তৈরি করা হয়। এতে খরচ পড়ে প্রায় ২৫ মিলিয়ন রিয়াল বা ৫৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সমমূল্য।
৬৫৮ বর্গমিটারের গিলাফটি তৈরিতে ৬৭০ কেজি কালো রেশম ব্যবহার করা হয়। ৪৭টি কাপড়ের টুকরোকে বিশেষ মেশিনে সেলাই করা হয়। এরপর কালো গিলাফের গায়ে মেশিনের ছাপ দিয়ে লেখা হয় আল্লাহর নাম ও গুণাবলি।আরব নিউজের তথ্য অনুযায়ী এরপর গিলাফটি গিল্ডিং অ্যান্ড এমব্রয়ডারি বিভাগে যায়। সেখানেই ক্যালিগ্রাফির ও শিল্পীরা গিলাফের চারদিকের সোনালি বেল্ট ও কাবার দরজার পর্দা তৈরি করেন।
তেইশ থেকে ষাট বছর বয়সী পঞ্চাশ জনের বেশি দক্ষ শিল্পী তাতে কোরআনের আয়াত ও অন্যান্য দোয়া এমব্রয়ডারি করেন। এ কাজে একশ কেজি খাঁটি রুপা এবং ১২০ কেজি সোনার প্রলেপযুক্ত রৌপ্য সুতা ব্যবহৃত হয়।কারুকার্যশোভিত আল্লাহর নাম এবং কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিগ্রাফি খচিত করা হয়। আরো লেখা থাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, ‘আল্লাহ জাল্লা জালালুহু’, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’, ‘ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান’ ইত্যাদি।উত্তর দিকের অংশে লেখা থাকে, ‘খাদেমুল হারামাইন শরিফাইনের বাদশাহ সালমান ইবনে আবদুর রহমান আল সাউদের নির্দেশে এই গিলাফ পবিত্র নগরী মক্কায় তৈরি করা হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...