হিজরি সনের ইতিহাস
রাসুল (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথিদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আরবি মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়েছিল। আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পবিত্র মক্কা থেকে মদিনায় রাসুলের (সা.) হিজরত থেকেই হিজরি সনের সূচনা। মূলকথা
নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বর্ষে রবিউল আউয়াল মাসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের ঘটনা মুসলিম জাতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে লক্ষ করেই ইসলামি সন প্রবর্তন করা হয়, যাকে ‘হিজরি সন’ বলা হয়। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তরি হওয়া ও দেশান্তরি করা। পরিভাষায় হিজরত হলো: ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। কামনা-বাসনা বিসর্জন দেওয়া, সংযম অবলম্বন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য পরিত্যাগ করাই হিজরতের অন্তর্নিহিত দর্শন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, যাদুল মাআদ, তারীখুল ইসলাম)।হিজরি সন মূলত চান্দ্রবর্ষনির্ভর। চান্দ্রমাস ২৯ ও ৩০ দিনে হয় বিধায় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে বর্ষ পূর্ণ হয়। সৌর মাস হয় ৩০ ও ৩১ দিনে বছর পূর্ণ হয় ৩৬৫ ও ৩৬৬ দিনে। তাই চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ সাধারণত বাৎসরিক ১০ দিন বা ১১ দিনের পার্থক্য হয়।
খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। ঐতিহাসিক আল বেরুনি কর্তৃক বিধৃত একটি বিবরণী থেকে জানা যায়, বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) একটি পত্রে উমর (রা.)-এর কাছে অনুযোগ করেন, ‘আপনি আমাদের কাছে যেসব চিঠি পাঠাচ্ছেন, সেগুলোতে কোনো সন–তারিখের উল্লেখ নেই, যার কারণে আমাদের অনেক অসুবিধা হয়।’ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে খলিফা হজরত উমর (রা.) একটি সন চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট হন।
প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ আল্লামা শিবলী নোমানী (র.) হিজরি সনের প্রচলন সম্পর্কে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ আল ফারূক গ্রন্থে উল্লেখ করেন: হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সনের শাবান মাসে খলিফা উমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সনের উল্লেখ ছিল না। তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন খলিফা জিজ্ঞাসা করেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে যে, এটি কোন সনে তাঁর সামনে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পেয়ে হজরত উমর (রা.) সাহাবায়ে কেরাম ও অন্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা মুতাবিক ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। হিজরতের বছর থেকে সন গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)।হজরত ওসমান (রা.) তৎকালে আরবে অনুসৃত প্রথা অনুযায়ী পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ শুরু (হিজরি সনের শুরু) করার ও জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন । (বুখারি ও আবু দাউদ)
এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১০ জুমাদাল উলা ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হিজরি সনের মাসগুলো মুসলমানদের জীবনধারার সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে মিশে আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন