সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হাফেজে হাদিস ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)



ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ইসলামী আইনের হাম্বলি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইসলামের ইতিহাসে সাহসী ব্যক্তিদের একজন। তাঁর চিন্তাধারা গভীরভাবে ঐতিহাসিক বিবর্তন ও আধুনিক চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তাঁর নাম আহমদ, উপনাম আবু আবদুল্লাহ, উপাধি শায়খুল ইসলাম ও ইমামুস সুন্নাহ, বংশগত পরিচয় সায়বানি। পিতার নাম মুহাম্মদ, দাদার নাম হাম্বল। এই প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ, আইনবিদ ও হাদিসবিদ হিজরি ১৬৪ সনের ১ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরবের বনি শায়বান গোত্রের লোক। মুসলমানদের ইরাক ও খোরাসান বিজয়ের সময় এ গোত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। উমাইয়া আমলে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর দাদা হাম্বল ইবনে হিলাল ছিলেন গভর্নর এবং তাঁর দপ্তর ছিল মার্ভে। বাবা মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল খোরাসানের সরকারি বাহিনীতে চাকরি করতেন। পরে তিনি বাগদাদ যান এবং তিন বছর পর ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাতা এতিম আহমদের লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন। মাতার তত্ত্বাবধানে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয়। তাঁর মাতাই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্বীয় মাতার তত্ত্বাবধানে প্রথমে কোরআন মজিদ হিফজ করেন। সাত বছর বয়স থেকে তিনি হাদিস অধ্যয়ন শুরু করেন। তৎকালীন সময়ে বাগদাদ নগরী ছিল পৃথিবীর অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী। এ নগরী তখন বহু জ্ঞানী, গুণী, ফকিহ ও হাদিসশাস্ত্রবিদের পদচারণে মুখরিত ছিল। ফলে দ্বিনি জ্ঞান লাভ করা তাঁর জন্য খুবই সহজ ছিল। স্থানীয় বড় বড় আলেমের কাছে নানা বিষয়ে জ্ঞানলাভের পর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন, কুফা, বসরা, মক্কা, মদিনা, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে ভ্রমণ করেন। তিনি হাম্বলি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ফিকহ অত্যন্ত সহজ ও সরল। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর বহু ছাত্র তাঁর মেধা ও স্মৃতিশক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাজকিরাতুল মুহাদ্দিসিন গ্রন্থে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি মাত্র চার বছর বয়সে কোরআন মাজিদ হিফজ করেন। তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য ইমাম আবু জুরইয়া বলেন, আমার শায়খদের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের চেয়ে বড় হাফিজে হাদিস আর কেউ নেই। তিনি একাধারে ফিকহ ও হাদিসশাস্ত্রের ইমাম ছিলেন। তিনি ছিলেন দুনিয়াবিমুখ, আল্লাহভীরু, পরহেজগার; মুত্তাকি এবং বড় আবেদ। দ্বিনের প্রতি ছিল তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস। সত্যের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। তিনি ছিলেন একজন দাতা ও অতিশয় বুদ্ধিমান। দ্বিনের হিফাজতের জন্য তিনি খলিফা মামুনের উত্তরসূরি কর্তৃক অনেক যাতনা সহ্য করেছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ছিলেন একজন সুদক্ষ হাদিসবিশারদ। হাদিসের দোষ-গুণ বিচারশক্তি, বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি ছিল তাঁর নখদর্পণে। তাঁর হাদিস সংকলনের প্রচেষ্টা ছিল শিক্ষাজীবন সমাপ্তির পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। একটি নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থ প্রস্তুতকল্পে তিনি অকল্পনীয় পরিশ্রম করেন। এ মর্মে তিনি প্রথমে বিভিন্ন সূত্রে সাড়ে সাত লক্ষাধিক হাদিসের এক বিশাল ভাণ্ডার সংগ্রহ করেন। অতঃপর দীর্ঘ সময় ব্যয় করে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে একটি হাদিস গ্রন্থ রচনা করেন, যা মুসনাদে আহমদ নামে সুপরিচিত।তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে_কিতাবুস সালাত, কিতাবুস সুন্নাহ ও মুতাজিলা মতবাদের ভ্রান্ত যুক্তির বিরুদ্ধে কারাগারে থাকাকালে লিখিত 'আর রা'দ আলাল জিন্দিকা'। যদিও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর মৌলিক শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ফিকহশাস্ত্রে শ্রেণীবদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়, তবু তাঁর ভক্তরা বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁর লিপিবদ্ধ উত্তরগুলো সংগ্রহ ও গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এতে আইনের 'হাম্বলি' বিশ্লেষণের জন্ম হয় এবং ইসলামী আইনের চতুর্থ মাজহাব প্রতিষ্ঠা লাভ করে।তার লিখিত কিতাব -
মুসনাদ আহমাদ
উসুলুস সুন্নাহ
কিতাবুল ঈমান
কিতাবুল মাসা‘ইল
কিতাবুল মানসুখ
রিসালাতুস সানিয়া
কিতাবুয যুহুদ (বইটি বাংলায় রাসূলের চোখে দুনিয়া, সাহাবিদের চোখে দুনিয়া এবং তাবিয়িদের চোখে দুনিয়া নামে তিন খণ্ডে প্রকাশিত)
আহকামুন নিসা
কিতাবুস সালাত
ফাযায়্যিলুস সাহাবা
আল ওয়ারা
আর-রাদ্দ আলাল জাহমিয়্যাহ (জাহমিয়া মতবাদের খণ্ডন)

তাঁর সম্পর্কে মনীষীরা বিভিন্ন প্রশংসামূলক উক্তি করেছেন। যেমন—ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আমি একদা বাগদাদ থেকে বের হয়েছি। কিন্তু ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের চেয়ে মুত্তাকি, পরহেজগার, বড় ফিকহবিদ এবং বড় আলেম প্রত্যক্ষ করিনি। হজরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ বলেন, ইমাম আহমদ এরূপ গুণের অধিকারী ছিলেন, যেসব গুণ আমি কারো মধ্যে দেখিনি; তিনি ছিলেন মুহাদ্দিস, হাফেজে হাদিস, শীর্ষস্থানীয় আলেম, পরহেজগার, দুনিয়াবিমুখ এবং বিবেকবান। হজরত ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ (রহ.) বলেন, তিনি জমিনে আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে হুজ্জত (দলিল) ছিলেন। হজরত আলী ইবনে মাদিনি (রহ.) বলেন, ইমাম আহমদ (রহ.) ইসলামের যে মর্যাদায় অবস্থান করেছেন, সে মর্যাদায় কেউ অবস্থান করতে পারেননি।

তিনি ৭৫ বছর বয়সে ২৪১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, মোতাবেক ৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই ৭৭ বছর বয়সে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন।তাঁকে বাগদাদে শহীদদের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। লাখ লাখ শোকাহত মানুষ তাঁর জানাজায় অংশ নেয়।

তথ্যসূত্র -ইন্টারনেট

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...