সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মর্সিয়া মাতম নয়



হিজরি ৬১ সনে ১০ মহররম কারবালায় শেষ নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। এছাড়া আদি মানব হযরত আদম (আ.) এই দিনে পৃথিবীতে আগমন করেন, তাঁর তওবা কবুল হয় এই দিনেই। এই দিনে হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পায়।ফেরাউনের জুলুম থেকে হযরত মুসা (আ.) পরিত্রাণ লাভ করেছিলেন ১০ মহররম। তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নীল নদ পার হয়েছিলেন এই দিনে। আর নীল নদে ডুবে যায় ফেরাউন ও তার অনুসারীরা।ইসলামের আরও অনেক তাৎপর্যময় ঘটনা ঘটেছিল এই দিনে।

ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে কারবালা প্রান্তরে। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীরা যুদ্ধ করতে গিয়ে ফোরাত নদীর তীরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শাহাদত বরণ করেন। হযরত ইমাম হোসাইন সেদিন ন্যায় ও সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনুকরণীয়।
কিন্তু শিয়ারা বর্তমানে হযরত ইমাম হোসাইনের (রা.) শাহাদতের শোকে যে মাতম করে তা আবেগ তাড়িত এক বেদাত ছাড়া কিছুই নয়।
মুসনাদে আহমদে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
‘তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো, আর ইহুদিদের বিরোধিতা করো। তাই তোমরা এক দিন আগে বা পরে রোজা বাড়িয়ে দাও।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৫৪)আশুরার রোজা একসময় ফরজ ছিল। পরে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর তা রহিত হয়ে গেছে। তখন থেকে আশুরার দিন রোজা রাখা মুস্তাহাব। সহিহ মুসলিম শরিফে এসেছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘কুরাইশরা জাহেলি যুগে আশুরার দিন রোজা রাখত। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) সেদিন রোজা রাখতেন যখন তিনি মদিনায় হিজরত করেন, তখন থেকে। তিনি নিজে রোজা রাখেন ও সাহাবাদের রোজা রাখার নির্দেশ দেন। অতঃপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হয়, তখন তিনি বললেন, যার ইচ্ছা রোজা রাখো, আর যার ইচ্ছা রোজা রাখবে না। ’ (মুসলিম, হাদিস : ১১২৫)
তাহলে বুঝা গেল আশুরার দিন শুধু কারবালার ঘটনার জন্য তাৎপর্যময় নয়। এটি ইহুদীদের কাছেও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন তারাও রোযা রাখতো। রাসূল সাঃ তাই ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আগে বা পিছে একদিন রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিন শিয়াদের মর্সিয়া মাতম আর “কারবালা” “কারবালা” বলে চিৎকার আমাদের এ দিবসের আসল তাৎপর্যময়তা ভুলিয়ে দিয়েছে। ভুলিয়ে দিয়েছে এদিন ধৈর্য আর সবরের শিক্ষা গ্রহণ করে রোযা রাখার নববী নির্দেশকে। হা হুতাশ আর মাতম মর্সিয়াকে বানিয়ে দিয়েছে দ্বীন। অথচ রাসূল সাঃ এর নির্দেশ হল এ দিন রোযা রাখা। এদিন জঘন্য কাজকর্ম থেকে মুক্ত থাকা। এ পবিত্র মাসের পবিত্রতা বিনষ্ট না করা।
আল্লামা সুয়ুতি (রহ.) লিখেছেন : বিভিন্ন বিপদের দিনকে শোকের দিন বানানো ইসলাম সমর্থন করে না। এটি জাহেলি কাজ। শিয়া সম্প্রদায় আশুরার দিনে এসব করে এ দিনের মর্যাদাবান রোজা ছেড়ে দেয়। (হাকিকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদআতি, খণ্ড-১, পৃ. ১৪৮)।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হযরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদতের দিনকে স্মরণ করে যথার্থই লিখেছেন -
‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’
আমাদের উচিত হযরত ইমাম হোসাইনের (রা.) ত্যাগের কথা স্মরণ করে তার আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করা। শহীদে কারবালা হজরত ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে গেছেন- ‘আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ্! আহ্! করো না, আঁচল ছিঁড়ো না, বরং ধৈর্য ধারণ করে থাকবে।
পিতা অবশ্যই পুত্র থেকে উত্তম। আলী (রা.)-কেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। অথচ তাঁর মৃত্যুর দিনকে শোকের দিন হিসেবে পালন করা হয় না। হোসাইন ও আলী (রা.)-এর চেয়ে উত্তম ওসমান (রা.)-কেও অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর শাহাদাতের দিনকেও শোকের দিন পালন করা হয় না। তাঁদের চেয়ে উত্তম হজরত ওমর (রা.)। তাঁর শহীদ হওয়ার দিনকে তো তারা শোকের দিন হিসেবে পালন করে না। কিন্তু এই মাতম কিসের?
কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়।
‘কতলে হোসাইন আসলমে মোরগে ইয়াজিদ হায়
ইসলাম জিন্দা হোতাহায় হর কারবালাকে বাদ।’
আমাদের কবির ভাষায়:
‘রক্ত পাথার সাতারি আবার আসে মুসলিম জাহানে দিন
জাগে একসাথে নবীন আশাতে লক্ষ সূর্য শংকাহীন।’

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...