ইমাম বুখারী (রহ.)



মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ বিন বারদিযবাহ(১৯ জুলাই ৮১০ – ১ সেপ্টেম্বর ৮৭০)একজন বিখ্যাত হাদীসবেত্তা ছিলেন। তিনি "সহীহ বুখারী" হাদীসের সংকলন রচনা করেন, যা মুসলমানদের নিকট হাদীসের সবোর্ত্তম গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর নাম মুহাম্মদ। উপনাম হলো আবু আবদুল্লাহ। আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদীস তাঁর উপাধি। বুখারা তাঁর জন্মস্থান বলে তাঁকে বুখারী বলা হয়। এ ব্যাপারে সকল ঐতিহাসিক একমত যে ইমাম বুখারী রহ. ১৯৪ হিজরী সনে শাওয়াল মাসের ১৩ তারিখে জুমা‘র নামাযের পর খুরাসানের প্রসিদ্ধ শহর বুখারায় (সাবেক, বর্তমান উজবেকিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন।

শিশুকালেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি তার মাতার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। দশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্ত করেন। শৈশব কালে মক্তবে লেখাপড়া করার সময়ই আল্লাহ্ তাঁর অন্তরে হাদীস মুখস্ত ও তা সংরক্ষণ করার প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। ১৬ বছর বয়সেই হাদীসর প্রসিদ্ধ কিতাবগুলো পাঠ সমাপ্ত করেন।১৮ বছর বয়সে তিনি হজ্জ পালনের জন্য মক্কায় গমণ করেন। মক্কায় অবস্থান করে তিনি ইলমে হাদীসের চর্চা শুরু করেন। অতঃপর তিনি এই উদ্দেশ্যে অন্যান্য দেশ ভ্রমণ করেন এবং এক হাজারেরও অধিক মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদীস সংগ্রহ করেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য সারা রাত জেগে তিনি অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রম করতেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। বলা হয় যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদীসের হাফেজ ছিলেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেনঃ আমার অন্তরে এক লক্ষ সহীহ হাদীস ও দুই লক্ষ যইফ হাদীস মুখস্ত রয়েছে। সহীহ বুখারীর অন্যতম ভাষ্যকার কুস্তুলানীর বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ছয় লক্ষ হাদীসের হাফেয ছিলেন। মুহাদ্দিছ ইবনে খুযায়মা (রঃ) বলেনঃ পৃথিবীতে ইমাম বুখারী অপেক্ষা অধিক অভিজ্ঞ এবং হাদীসের হাফেজ আর কেউ জন্ম গ্রহণ করে নি। কেউ কেউ বলেনঃ খোরাসানের যমীনে ইমাম বুখারীর মত আর কেউ জন্ম গ্রহণ করেন নি।
ইমাম বুখারী (রঃ) থেকে অসংখ্য মুহাদ্দিস সহীহ বুখারী বর্ণনা করেছেন। খতীব বাগদাদী (রঃ) বুখারীর অন্যতম রাবী ফিরাবরির বরাত দিয়ে বলেন যে, তার সাথে প্রায় সত্তর হাজার লোক ইমাম বুখারী থেকে সরাসরি সহীহ বুখারী পড়েছেন। তাঁর শিষ্যবৃন্দের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন- আবুল হাসান মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, আবূ ঈসা আত্ তিরমিযী, আবূ আব্দুর রহমান আন্ নাসায়ী প্রমুখ। এরা সবাই হলেন হাদীস শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ এক একজন ইমাম ও হাফেযে হাদীস। বাকী অন্যান্যরা হলেন হাফেযে হাদীস।
ইমাম বুখারী ইলম হাসিলের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং তৎসময়ে বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফকিহর সান্নিধ্যে অতিবাহিত করতে থাকেন। তিনি বসরা, বাগদাদ, সিরিয়া, মিসর, খোরাশান ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি দুইবার সিরিয়া ও মিসর ভ্রমণ করেছি, বসরায় গিয়েছিলাম চারবার। ছয় বছর হেজাজে অবস্থান করেছি, কুফা ও বাগদাদে কতজন মুহাদ্দিসের সাক্ষাৎ পেয়েছি, তা বর্ণনার বাইরে।
তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ কতিপয় গ্রন্থের মধ্যে আছে- সহীহ বুখারী, আদাবুল মুফরাদ, রফউল ইয়াদাইন ফিস্ সলাত, র্বিরুল ওয়ালিদাইন, আত্ তারীখুল কাবীর, আল মুসনাদুল কাবীর ইত্যাদি।
ইমাম বুখারী স্বীয় শিক্ষক ইসহাক বিন রাহওয়াইহ থেকে এই গ্রন্থ রচনার প্রেরণা লাভ করেন। একদিন তিনি একটি এমন গ্রন্থের আশা ব্যক্ত করেন যাতে শুধু সহীহ হাদীস লিপিবদ্ধ থাকবে। তাঁর ছাত্রদের মাঝে ইমাম বুখারী তখন এই কঠিন কাজে অগ্রসর হন।২১৭ হিজরী সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি মক্কা শহরের হারাম শরীফে এই গ্রন্থের জন্য হাদীস সংকলন শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২৩৩ হিজরী সনে এর সংকলনের কাজ সমাপ্ত হয়। আবুল ফজল মোহাম্মদ বিন তাহেরের বর্ণনা মতে, ‘‘ইমাম বুখারী তার হাদীস গ্রন্থ কাজ বুখারাতে বসে শেষ করেছেন। এক বর্ণনায় বসরা শহরের কথা আছে।তবে উল্লিখিত সকল বর্ণনা নির্ভুল। কেননা হাদীস সংকলন কালে তিনি উল্লিখিত সকল নগরীতে অবস্থান করেছেন।ইমাম বুখারী স্বয়ং বলেছেন, ‘‘আমি আমার সহিহ বুখারি সঙ্গে নিয়ে বসরা শহরে ৫ বছর অবস্থান করেছি এবং আমার কিতাব প্রণয়ের কাজ শেষ করি। আর প্রতি বছরই হজ পালন করি এবং মক্কা হতে বসরাতে ফিরে আসি।’’ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর প্রায় ৬ লাখ হাদীস মুখস্থ ছিল। তিনি ৬ লাখ হাদিস হতে যাচাই বাছাই করে ১৬ বছর নিরলস সাধনা করে এ প্রসিদ্ধ গ্রন্থখানি প্রণয়ন করেন।ইবনে আল সালাহ-এর হিসাব মতে: "দ্বিরুক্তি সহ বুখারী শরীফে হাদীসের সংখ্যা ৭২৭৫।
বুখারী রহ. ২৫৬ হিজরী সনে ৬২ বছর বয়সে শনিবার ঈদুল ফিতরের রাত্রিতে এশার নামাযের সময় ইন্তেকাল করেন এবং ঈদুল ফিতরের দিন যোহর নামাযের পর সমরকন্দ শহর থেকে তিন মাইল দূরে খরতঙ্গ নামক স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। দাফনের পর তাঁর কবর থেকে মিশক আম্বরের মতো সুগন্ধি বের হতে থাকে এবং কবর বরাবর আকাশে লম্বাকৃতি একটি সাদা রেখা দেখা দিলে মানুষ তা বিস্ময়করভাবে প্রত্যক্ষ করে। পরে আল্লাহর একজন নেককার বান্দা আল্লাহর দরবারে এই সুগন্ধি বন্ধ করার জন্য দোয়া করলে তা বন্ধ হয়ে যায়। (হাফিজ ইবনে কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৩)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল