ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ.) একজন যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফিকহবিদ ও মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি মুসলমানদের প্রধান চার ইমামের একজন। মালেকী মাযহাব তারই প্রণীত মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। তার সংকলিত মুয়াত্তা বিখ্যাত এবং প্রাচীনতম হাদীসগ্রন্থ।ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রহ.) আরবের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ইসলামের আবির্ভাবের আগে ও পরে আরবে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিল। এই পরিবারের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন ইয়েমেন থেকে। ইমাম মালিক পবিত্র মদীনা নগরীতে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষানুরাগী মুসলিম পরিবারে জন্মলাভ করেন।তাঁর নাম মালেক, উপনাম আবু আবদুল্লাহ, উপাধি ইমামু দারিল হিজরাহ। পিতার নাম আনাস। জন্মের সন নিয়ে কিছু মতামত থাকায় ইমাম যাহাবী রহ. বলেন : বিশুদ্ধ মতে ইমাম মালিক -এর জন্ম সন হল ৯৩ হিজরী, যে সনে রাসূলুল্লাহ সা.-এর খাদেম আনাস বিন মালিক রা. মৃত্যুবরণ করেন।এবং ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর চেয়ে ১৩ বছরের ছোট।
ইমাম মালিক ইবনে আনাস মদিনায় শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর দাদা, বাবা ও চাচা সবাই হাদিসবেত্তা ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই বালক মালিককে হাদিস এবং জ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা দেন।তাঁর পিতা তাবে-তাবেঈ ও হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন, যার কাছ থেকে ইমাম যুহুরীসহ অনেকেই হাদীস বর্ণনা করেন। খুদ ইমাম মালিকও পিতার নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর দাদা আবূ আনাস মালিক রহ. প্রসিদ্ধ তাবেঈ ছিলেন, যিনি ওমার, আয়িশা ও আবু হুরায়রা রা. হতে হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর পিতামহ আমির বিন আমর রা প্রসিদ্ধ সাহাবী ছিলেন। এ সম্ভ্রান্ত দ্বীনী পরিবেশে জ্ঞানপিপাসা নিয়েই তিনি প্রতিপালিত হন।
ইমাম মালিক রহ. অসংখ্য বিদ্যানের নিকট শিক্ষালাভ করেন। ইমাম যুরকানী রহ. বলেন : ‘‘ইমাম মালিক রহ. ৯০০ এর অধিক শিক্ষকের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইমাম মালিক স্বীয় গ্রন্থ মুয়াত্ত্বায় যে সব শিক্ষক হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাদেরই সংখ্যা হল ১৩৫ জন, যাদের নাম ইমাম যাহাবী ‘‘সিয়ার’’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন নিম্নরূপ : ১. ইমাম রাবীয়া বিন আবূ আবদুর রহমান রহ.। ২. ইমাম মুহাম্মদ বিন মুসলিম আয্যুহুরী রহ.। ৩. ইমাম নাফি মাওলা ইবনু ওমার রহ.। ৪. ইব্রাহীম বিন উক্বাহ রহ.। ৫. ইসমাঈল বিন মুহাম্মদ বিন সা’দ রহ.। ৬. হুমাইদ বিন কায়স আল ‘আরজ রহ.। ৭. আইয়ূব বিন আবী তামীমাহ আসসাখতিয়ানী রহ. ।
তাঁর শিক্ষা থেকে যাঁরা আলোকিত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে খলিফা আল মানসুর, খলিফা হারুন মামুনের মতো শাসক, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ি, সুফিয়ান সাওরি, কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.)-এর মতো ইসলামের আইনবিশারদ, ইবনে শাহাব জাহরি, ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আনসারীর মতো বিদগ্ধজন, ইবরাহীম বিন আদহাম, জুন্নুন মিসরি, মুহাম্মদ বিন ফাজিল বিন আব্বাসের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা ছিলেন।
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, তার সংখ্যা এক হাজার তিন শর বেশি।ইমাম মালিক রহ. হলেন ইমামু দারিল হিজরাহ, অর্থাৎ মদীনার ইমাম। অতএব মদীনার ইমামের ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য কে না চায়। তাই তাঁর ছাত্র অগণিত। ইমাম যাহাবী উল্লেখযোগ্য ১৬৬ জনের নাম বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাতীব বাগদাদী ৯৯৩ জন উল্লেখ করেন। ইমামের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ছাত্রের নাম নিম্নে প্রদত্ত্ব হল : ১. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস আশ্শাফেঈ রহ.।২. ইমাম সুফাইয়ান বিন উয়ায়নাহ রহ.। ৩. ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রহ.। ৪. ইমাম আবু দাউদ আত্তায়ালিসী রহ.। ৫. হাম্মাদ বিন যায়দ রহ.। ৬. ইসমাঈল বিন জাফর রহ.। ৭. ইবনু আবী আযযিনাদ রহ.।
তিনি ১২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন বলে জানা যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল : ১. আল মুয়াত্ত্বা। হাদীসের জগতে কিছু ছোট ছোট সংকলন শুরু হলেও ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্ত্বা’ সর্ব প্রথম হাদীসের উল্লেখযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য সংকলন। এ গ্রন্থে ইমাম মালিক রহ. রাসূল সা.-এর হাদীস, সাহাবী ও তাবেঈদের হাদীস এবং মদীনাবাসীর ইজমা সহ অনেক ফিকহী মাসআলা বিশুদ্ধ সনদের আলোকে সংকলন করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাধনার পর, কেউ বলেন ৪০ বৎসর সাধনার পর এ মূল্যবান গ্রন্থ সংকলন করেন। সে সময় বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে হাদীসের গ্রন্থ ‘মুয়াত্ত্বা’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন : ‘‘কিতাবুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন এর পরই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ হল ইমাম মালিকের ‘‘মুয়াত্ত্বা’’। হ্যাঁ, সহীহ বুখারীর সংকলনের পূর্বে মুয়াত্ত্বাই সর্ব বিশুদ্ধ গ্রন্থ ছিল। অবশ্য এখন সহীহ বুখারী সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ।২. ‘‘কিতাবুল মানাসিক’’ ৩. ‘‘রিসালাতুন ফিল কাদ্র ওয়ার্রাদ আলাল কাদারিয়া’’। ৪. ‘‘কিতাব ফিন্নুজুমি ওয়া হিসাবি মাদারিয্যামানি ওয়া মানাযিলিল কামারি’’। ৫. ‘‘কিতাবুস সিররি’’। ৬. ‘‘কিতাবুল মাজালাসাত’’। ইত্যাদি সহীহ সনদে প্রমাণিত যে, এ সব ইমাম মালিক রহ.-এর সংকলিত ও রচিত গ্রন্থ। ইহা ছাড়াও আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম মালিক রহ. এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, হাদীস সংকলনে অগ্রনায়ক। যদিও তাঁর পূর্বে কেউ কেউ হাদীস সংকলন করেন, যেমন ইমাম যুহুরী, কিন্তু ইমাম মালিক রহ.-এর হাদীসের সাধনা, সংগ্রহ ও সংকলন ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এজন্যই তাঁর সংকলিত গ্রন্থকে বলা হয়, ‘‘আল্লাহর কিতাব কুরআনের পর সর্ববিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ ইমাম মালিকের মুয়াত্ত্বা গ্রন্থ। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ (রহ.)-এর মতে ইমাম মালিক (রহ.) সংগৃহীত হাদিসের মধ্যে 'মুয়াত্তা' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যথার্থ হাদিস সংকলন। পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পরই তিনি হাদিসগুলোর যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন। প্রথমে মুয়াত্তায় ১০ হাজারের বেশি হাদিস সংকলিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা এক হাজার ৭২০টিতে হ্রাস করা হয়। হাদিসের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের পরই ইমাম মালিক (রহ.) 'মুয়াত্তা' সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
একজন হাদিস সংগ্রাহক ও হাদিসবেত্তা হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে ইমাম মালিক (রহ.) সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া তিনি অন্যদের সঙ্গ এড়িয়ে চলতেন। ইমাম হাম্বল (রহ.)-এর মতে, ইমাম মালিক (রহ.) একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনো হাদিস শুনলে তার নির্ভরযোগ্যতা ও যথার্থতার ব্যাপারে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ না হয়ে অন্য কারো কাছে বলতেন না। পরবর্তী যুগের জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাঁর সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ইমাম মালিক (রহ.) একজন সেরা আইনবিদও ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৬০ বছর মদিনায় বিভিন্ন জটিল বিষয়ের ওপর শরিয়তের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে সমস্যার নিষ্পত্তি করেছেন। ইমাম মালিক (রহ.) চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ধর্মানুরাগের জন্য খ্যাত ছিলেন।
আব্বাসীয় খলিফা মনসুর তাঁর গুণগ্রাহী হলেন। ইমাম মালিকের বয়স তখন ২৫ বছর। প্রকৃতপক্ষে তিনি ফাতেমীয় বংশের নাফস জাকারিয়াকে খলিফা পদের জন্য উপযুক্ত মনে করতেন। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন যে জনগণকে মনসুরের কাছে আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন তিনি বললেন, যেহেতু মনসুর জনগণকে বাধ্য করছে তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে, সে জন্য শরিয়তে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। যখন মনসুরের এক চাচাতো ভাই জাফরকে মদিনার গভর্নর পদে নিযুক্ত করা হলো, তখন তিনি মদিনাবাসীকে বলেছিলেন মনসুরের প্রতি তাদের আনুগত্যের শপথ নবায়ন না করতে। তিনি গভর্নরের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে সাহসিকতার সঙ্গে যথারীতি সত্যের সাক্ষ্যদাতা হিসেবে জবরদস্তিমূলক যাবতীয় কাজের অশুদ্ধতার ফতোয়া দিতেই থাকলেন এবং শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ জানালেন। ক্রুদ্ধ গভর্নর তাঁর কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করার শাস্তি হিসেবে ইমামকে ৭০টি বেত্রাঘাত করার নির্দেশ দেন। সে অনুসারে তাঁর খোলা পিঠে ৭০টি বেত্রাঘাত করার ফলে পিঠ ফেটে রক্ত ঝরতে থাকে। সেই রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মসজিদে নববীতে এলেন এবং পিঠের রক্ত সাফ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন। নামাজান্তে উৎসুক জনতার দিকে ফিরে বললেন_সাইদ বিন মুসাইয়্যিবকে যখন বেত্রাঘাত করা হয়েছিল তখন তিনিও এই মসজিদে নববীতে এসে সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালকের দরবারে সত্যের সাক্ষ্যদানের পার্থিব পুরস্কার পাওয়ার প্রত্যাশা না করে নামাজ আদায় করেছিলেন। (তায্ঈনুল মামালিক, আবী ওহাব)।
খলিফা মনসুর ইমামের প্রতি গভর্নরের অত্যাচারের কথা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে আদেশ দিলেন_জাফরকে ক্ষমতাচ্যুত করে গাধার পিঠে চড়িয়ে মদিনা থেকে বাগদাদে নিয়ে আসা হোক। শেষে জাফর ইমামের কাছে স্বহস্তে চিঠি লিখে নিজের অজ্ঞতার কথা জানিয়ে ক্ষমা চাইলেন। পরের বছর ইরাক এবং হিজাজের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত হলে মনসুর হজ করতে এলেন। তখন ইমাম মালিকের সঙ্গে মনসুরের সাক্ষাৎ হয়। মনসুর ইমাম সাহেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বললেন, 'আমি আল্লাহর দুশমনকে (জাফরকে) পদচ্যুত করেছি এবং আদেশ করেছি, নিকৃষ্টতম অপমানে লাঞ্ছিত করে গাধার পিঠে চড়িয়ে বাগদাদে পাঠিয়ে দিতে।' ইমাম সাহেব বললেন, 'এই প্রতিশোধের প্রয়োজন নেই আমিরুল মুমিনিন। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার প্রতি আমার ক্ষোভকে উৎসর্গ করে তাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।' (কিতাবুল উম্মাহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯০-২৯৭)। পরে মনসুর সম্মানসূচক পোশাক 'খিলাত' পেশ করার আদেশ দিলেন। দরবারের প্রথা অনুযায়ী খাদেম তা এনে সম্মানিতের কাঁধে ঝুলিয়ে দেবে। যথারীতি খাদেম তা করতে গেলে ইমাম সাহেব দু-পা পিছিয়ে নীরবে তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। বাদশাহ মনসুরের বুঝতে দেরি হলো না। খাদেমকে তিনি বললেন, আবু আবদুল্লাহর এই উপহার তাঁর অবস্থানস্থলে পেঁৗছে দাও। খলিফা মনসুরের দরবারে আসা সবাইকে তাঁর হস্তচুম্বন করতে হতো। কিন্তু ইমাম মালিক (রহ.) খলিফাকে এভাবে শ্রদ্ধা জানানোর প্রথাকে মানবিক মর্যাদাবিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করতেন। তাই এ কাজটি তিনি কখনো করেননি (তবকাত)।
ইমাম মালিকের মর্যাদা এবং তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতা সম্পর্কে মদিনার সর্বস্তরের আলেম, বিশেষজ্ঞ এবং শায়খদের মধ্যে কোনো বিতর্ক ছিল না। এককথায় তিনি ছিলেন সর্বজন মান্য। এ ব্যাপারে ইমাম মালিকের বিনয় ও সতর্কতাও কম ছিল না। যত দিন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর স্বীকৃত ৭০ জন আলেম-বিশেষজ্ঞ তাঁর দক্ষতা-যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ ফতোয়া ঘোষণা করেননি, তত দিন তিনিও উচ্চতর এ আসনে নিজে গিয়ে বসেননি। তাঁর চরিত্রে বিনয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণিত এবং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ইমাম মালিক (রহ.) যখন কোনো মাসআলা বা ফতোয়া নিজের বিচার-বুদ্ধির রায় অনুযায়ী দিতেন, তখন তিনি এ আয়াত পড়ে নিতেন_'আমরা কেবল ধারণাই করি এবং এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই।' (মনাকিবে মালিক, সাঈদ বিন সুলাইমান)। তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করেই একেকটি ফতোয়া বা মাসআলার জবাব দিতেন। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, কখনো কখনো এমন সব মাসআলা সামনে আসে, যাতে আমার আহার-নিদ্রা হারাম হয়ে যায়। ইবনে আবি আওয়িস তখন বললেন, আপনার কথা তো মানুষ পাথরে লেখা বাণীর মতো জ্ঞান করে! তার পরও আপনি কেন এত কষ্ট সহ্য করবেন? ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, 'ইবনে আবি আওয়িস! তাহলে তো আমার আরো বেশি ভাবনা-চিন্তা করা উচিত!' (আয্ যাওয়াদী, রহমান বিন আবদুল আযীয আল-আমরী)। কোনো মাসআলায় ভুল হয়ে গেলে কেউ যদি তা শুধরে দিত, সঙ্গে সঙ্গে ইমাম মালিক (রহ.) তা স্বীকার করতেন এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। ১৭০ হিজরিতে আব্বাসি খিলাফতের মসনদে আরোহণ করেন হারুন অর-রশিদ। তিনি খিলাফতের মসনদে আরোহণ করে প্রথম বছরেই হজে এলেন। মদিনায় তাঁর আগমন উপলক্ষে শহরের নাগরিকরা স্বাগত জানাতে এগিয়ে এল। ইমাম মালিকও এগিয়ে এলেন। হারুন অর-রশিদ তাঁকে দেখে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করে এগিয়ে এসে বললেন, আপনার রচনাবলি দেশের সব জায়গায় পেঁৗছে দিয়েছি এবং আমাদের বংশের প্রত্যেকটি ছেলের জন্য বাধ্যতামূলক পাঠ্য করে দিয়েছি। ১৭৪ হিজরিতে আমিন ও মামুন_এই দুই শাহজাদাকে সঙ্গে নিয়ে হারুন অর-রশিদ হজে এলেন। মুয়াত্তা শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করে ইমাম সাহেবকে মদিনার রাষ্ট্রীয় ভবনে আহ্বান করলেন। ইমাম সাহেব মুয়াত্তা ছাড়া নিজেই দেখা করতে এলেন। হারুন মুয়াত্তা না আনার জন্য অনুযোগ করলে ইমাম সাহেব বললেন, হারুন অর-রশিদ! বিদ্যা তোমার ঘর থেকে বেরিয়েছে, চাও তো অপমান করো, নয়তো সম্মান করো। হারুন অর-রশিদ লজ্জিত হয়ে দুই শাহজাদাকে নিয়ে সোজা দরসের মজলিসে হাজির হলেন। অনেক ছাত্রের ভিড় দেখে হারুন অর-রশিদ বললেন_এদের একটু সরে যেতে বলুন! ইমাম সাহেব বললেন, ব্যক্তিস্বার্থের জন্য বৃহত্তর স্বার্থকে খুন করা যায় না। হারুন অর-রশিদ ইমামের মসনদে বসে পড়লেন। এবারও ইমাম বললেন, আমিরুল মুমিনিন, 'বিনয়' এখানে খুবই প্রয়োজন! হারুন অর-রশিদ নিচে নেমে বসলেন। ইমাম মালিক (রহ.) খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি বলতেন, কোনো ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তার উচ্চ শিখরে পেঁৗছতে পারে না, যতক্ষণ সে দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত না হয়। দারিদ্র্য হচ্ছে মানুষের প্রকৃত পরীক্ষা। দারিদ্র্য মানুষের সুপ্ত চেতনাকে জাগ্রত করে এবং সব বাধাবিপত্তি অতিক্রমের শক্তি জোগায়।
ইমাম মালিক রহ. সম্পর্কে আলিম সমাজের প্রশংসা :
১. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন : ‘‘আলিম সমাজের আলোচনা হলে ইমাম মালিক তাদের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, কেউ ইমাম মালিকের স্মৃতিশক্তি, দৃঢ়তা, সংরক্ষণশীলতা ও জ্ঞানের গভীরতার সমপর্যায় নয়। আর যে ব্যক্তি সহীহ হাদীস চায় সে যেন ইমাম মালিকের কাছে যায়।
২. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন : ‘‘বিদ্যানদের অন্যতম একজন ইমাম মালিক, তিনি হাদীস ও ফিকাহ শাস্ত্রে একজন অন্যতম ইমাম, জ্ঞান-বুদ্ধি ও আদাব আখলাকসহ হাদীসের প্রকৃত অনুসারী ইমাম মালিকের মত আর কে আছে?
৩. ইমাম নাসায়ী রহ. বলেন : ‘‘তাবেঈদের পর আমার কাছে ইমাম মালিকের চেয়ে অধিক বিচক্ষণ আর কেউ নেই এবং হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে অধিক আমানতদার আমার কাছে আর কেউনেই।
তিনি সুদীর্ঘ ৫০ বছরকাল শিক্ষা ও ফতোয়া দানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রিয়নবী (সা.)-এর সম্মানার্থে তিনি মদিনায় পাদুকা ব্যবহার করতেন না এবং বাহনে চড়তেন না। তিনি বলতেন, যে জমিনে প্রিয়নবী শায়িত আছেন, সে জমিনে আমি বাহনে চড়তে লজ্জাবোধ করি।
দীর্ঘজীবন ইসলামের শিক্ষা বিস্তারের মহান দায়িত্ব পালনের পর ১৭৯ হিজরি সনের ১১ রবিউল আউয়াল ৮৬ বছর বয়সে তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন।তাকে মসজিদে নববীর পাশে মাকবারাতুল বাকী কবরস্তানে দাফন করা হয়।
তথ্যসূত্র -ইন্টারনেট
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন