সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুসলমানদের স্পেন বিজয়

 


প্রাচীনকালে স্পেন আইবেরীয় উপদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। অপরূপ সুন্দর এই উপদ্বীপটি মুসলিম শাসনামলে আন্দালুস নামে পরিচিতি লাভ করে। দেশটি ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ২,৯৫,১৪০ বর্গমাইল। চারদিকে প্রাকৃতিক সীমারেখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। উত্তর ও পশ্চিমে বিশাল আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর এবং পূর্বে পীরেনীজ পর্বতমালা।

খোলাফায়ে রাশেদার যুগ শেষ হওয়ার পর উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুসলিম বিজয় দুর্বার গতিতে বিস্তৃত হতে থাকে। ৬৯৮ সালে মুসলিম সেনাদের রণনিপুণতায় উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকা মুসলিম সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় আফ্রিকা ছিল অন্ধকারের মহাদেশ হিসেবে পরিচিত। দুর্গম পাহাড়-পর্বত, জন্তু-জানোয়ার আর জঙ্গলের দেশ বলা হতো আফ্রিকাকে। এই জঙ্গলের দেশে মুসলিমগণ জ্ঞানের আলো জ্বালালেন। সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হলো তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মৌরতানিয়া ও মরক্কো। উত্তর আফ্রিকার দুর্ধর্ষ, অদম্য ও যুদ্ধে অজেয় ‘বারবার’ জাতি ইসলামের সৌন্দর্যের কাছে পরাজিত হলো। তারা মুসলিম নেতাদের চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। সত্যের এ আলোর ঝলক ছড়িয়ে পড়লো পার্শ্ববর্তী স্পেনে। এ সময়ে স্পেনের রাজা ছিলেন রডারিক। তিনি ছিলেন গোঁড়া খ্রিস্টান। ছিলেন স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। তার নির্যাতনে মানবতা হয়ে উঠেছিল নিষ্পেষিত। এসময় চার্চের ক্ষমতা ছিল রাজাদের চেয়ে অনেক বেশি। রাজারা ছিলেন পুরোহিতদের হাতের পুতুল। রাজা ও পুরোহিত-এই দুই শ্রেণির মানুষই ছিলেন দুর্নীতিপরায়ণ, সীমাহীন বিলাসী ও চরিত্রহীন। রাজাদের রাজপ্রাসাদ আর পুরোহিতদের মঠ ও গির্জাগুলো পরিপূর্ণ থাকতো সুন্দরী যুবতী নারী দিয়ে। তাদের শোষণে শোষিত জনগণের আর্তনাদে ভারী হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। কিন্তু তাদের এই আর্তনাদ আর চিৎকার দেয়ালের বাইরে আসতো না। মুসলিম গভর্নর যেন তাদের এ কান্নার আওয়াজ দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলেন। মরক্কোর অদূরে ছিলো স্পেন শাসিত সিউটা দুর্গ। এ দুর্গের গভর্নর ছিলেন কাউন্ট জুলিয়ান। রডারিক স্পেনের ক্ষমতায় এলে জুলিয়ান তার কন্যাকে প্রথা অনুযায়ী শিক্ষা অর্জনের জন্য গিসিগথিক রাজার দরবারে পাঠান। কথিত আছে যে রডারিক তাকে ধর্ষন করেন এর ফলে জুলিয়ান অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে আরবদেরকে ভিসিগথ রাজ্যে আসতে আমন্ত্রণ জানান।তিনি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে হাজির হলেন মুসা বিন নুসাইরের দরবারে। সে সাথে মুসলিমদেরকে জিব্রাল্টার প্রণালী গোপনে পার করে দেয়ার ব্যাপারে তিনি চুক্তিতে আবদ্ধ হন। আর মজলুম মানবতাকে উদ্ধারে স্পেনে আক্রমণ করতে আবেদন করলেন। তিনি মুসা বিন নুসাইরকে স্পেনের রাজা ও পুরোহিতদের অপকর্মের সব কথা জানিয়ে দিলেনমুসা তার তলোয়ার কোষমুক্ত করলেন। তিনি বয়সে তরুণ তারেক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
৭১১ সালে জুনে মুসলমানরা অভিযানের নিমিত্তে জাহাজে আরোহণ করলেন। স্বল্প রসদ আর অল্প সৈন্য নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। ইউরোপের মাটিতে মুসলিম বাহিনীর প্রথম পদক্ষেপ। এ এক নতুন অনুভূতি। সৈন্যদের নিয়ে তারিক একটা পাহাড়ের কাছে অবতরণ করলেন, যা পরবর্তীতে ‘জাবালুত তারেক’ বা তারেকের পাহাড় নামে পরিচিতি পায়। স্পেনে পৌঁছে তারেক জাহাজগুলো পুড়িয়ে দিলেন। মুসলিমবাহিনীর সামনে এখন বিজয় কিংবা মৃত্যু ছাড়া কিছুই রইলো না। এমতাবস্থায় তারেক সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দিলেন। যে ভাষণটি পৃথিবীতে হয়ে আছে স্মরণীয়। ভাষণটির মর্মার্থ ছিলো এমন: ‘হে সাহসী যুবক ভাইয়েরা! হে আমার যোদ্ধাগণ! তোমরা পালাবে কোথায়? এখন পিছু হটবার কোনো সুযোগ নেই। তোমাদের সামনে শত্রু আর পিছনে সমুদ্র। না পারবে পিছনে পালাতে আর না সামনে। এখন তোমাদের সামনে বিজয় অথবা শাহাদাত ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ নেই। আর জেনে রেখো, আমরা এসেছি এদেশকে স্বদেশভূমিতে পরিণত করতে। আমরা তো সেই আল্লাহর বান্দা, যিনি বদর, হুনায়ন, কাদিসিয়া, আজনাদাইনের রণক্ষেত্রে বিপদের সময় সাহায্য করেছিলেন। আমরা যুদ্ধ করি সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে; পার্থিব ধন-দৌলত লাভের জন্য নয়। আমরা তো অদ্বিতীয় আল্লাহতে বিশ্বাসী। এসো আমরা সত্যের পথে হই গাজী অথবা শহীদ।’ জ্বালাময়ী এই ভাষণে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হৃদয়ে যেন আগুন প্রজ্জ্বলিত হলো। তাঁরা শপথ নিলেন জয়ের অথবা শহীদের। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হলো স্পেনের আকাশ বাতাস। অতঃপর সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বেজে উঠলো রণশিঙ্গা। তারিকের সেনাবাহিনীতে মোট ৭০০০ জন যোদ্ধা ছিল। বলা হয় যে মূসা ইবনে নুসাইর আরো ৫০০০ সৈনিক পাঠিয়েছিলেন। ছোটো বাহিনী এগিয়ে চললো সম্মুখপানে। তাদের চোখে মুখে ছিল দৃপ্ত শপথ। কিন্তু চলনে বলনে ছিলো না কোনো অহংকার এবং ঔদ্ধত্য। বিনয়াবনত ছিল তাদের চিত্ত বিচরণ। উদ্দেশ্য ছিলো মানবিক ও মহৎ। তারেকের বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছিল স্বগতিতে। তারেক পথিমধ্যে কয়েকবার বাধার সম্মুখীন হলেন। বাধা অতিক্রম করে তিনি সরাসরি রাজা রডারিকের মুখোমুখী হলেন। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত মুসলিম সেনাবাহিনী।ওদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে সমহিমায় হাজির রডারিক বাহিনী। ইস্পাতের বর্মদ্বারা আচ্ছাদিত তার ত্রিশ হাজার সৈন্য। শুরু হলো ইউরোপের মাটিতে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম বড় যুদ্ধ। দুই লাখ খ্রিস্টানবাহিনীর সাথে ক্ষুদ্র মুসলিমবাহিনীর অসম যুদ্ধ চললো সাতদিন ধরে। যুদ্ধ গড়ালো অষ্টম দিনে। সুশৃংঙ্খল মুসলিম বাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেলেন রডারিকের সৈন্যরা। তৃণের মতো উড়ে গেলো খ্রিস্টানবাহিনী। তারেকের সম্মুখ হামলায় রাজা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। পালাতে শুরু করলো তার সৈন্যরা। নদীতেই সলিল সমাধি ঘটলো অনেকের। ১৯ জুলাই গুয়াডালেটের যুদ্ধে রডারিক পরাজিত ও পানিতে ডুবে মারা গেলেন। হাজার হাজার খ্রিস্টান সৈন্যের লাশ পড়ে থাকলো মাটিতে। ৭১২ সালে মুসলমানদের করতলগত হলো স্পেনের সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর।৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল। সুদীর্ঘ ৭৮২ বছর। মুসলিমরা স্পেনকে পরিণত করলো সমগ্র ইউরোপের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে।যে ভূখণ্ড প্রায় আটশত বছর মুসলমানরা শাসন করেছে সেখানে ইসলাম এখন এতটাই অপরিচিত; পাকিস্তানের আল্লামা তাকী উসমানী তার সফরনামায় লেখেন, ‘আমরা যখন বিমানবন্ধরের এক কোণে নামায আদায় করি তখন স্পেনের মানুষ জটলা বেধে আমাদের দেখতে থাকে। কী করছে এই দুই আগন্তুক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...