পিতা -পুত্র
পিতা পুত্রের সমন্ধে অতিমাত্রায় আবেগ ও অনুভূতি মিশ্রিত। যে আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার সীমা পরিসীমা নির্ণয় ও আচ করা অসম্ভব।
১০০ বছর বয়সে নিঃসন্তান নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) পুত্র সন্তানের জনক হলেন। ঐশ্বরিক আদেশ পিতা পুত্রের মধ্যে সাময়িক ছেদ ঘটাল। আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম (আ.) এর কঠিন পরীক্ষা নিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ:) বিবি হাজেরা আর ইসমাইলকে নিয়ে বহুদূরে বর্তমান কাবাগৃহের স্থানে ও জমজম কূপের কাছে একটা গাছের নীচে তাদেরকে রাখলেন। ( তখন জমজম কূপ ছিল না ) এটি ছিল অনাবাদী, জনমানব শূন্য, পানিবিহীন একটা জায়গা। প্রাণ বাঁচানোর জন্য অত্যন্ত কষ্টকর একটা জায়গা। হযরত ইব্রাহিম সামান্য পানি ও খেজুর বিবি হাজেরার পাশে রেখে চলে আসেন। আল্লাহর হুকুমে প্রিয় পুত্র ও প্রিয়তমা স্ত্রীকে জনমানবহীন মরুর বুকে ফেলে আসার অনুভূতি কী হয়েছিল আমরা জানি না।তবে
হযরত ইব্রাহিম (আ.) চলে যাওয়ার সময় দোয়া করলেন-‘হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার পবিত্র ঘরের নিকটে এমন এক ময়দানে আমার স্ত্রী ও পুত্রকে রেখে যাচ্ছি, যা (অনাবাদি) শস্যের অনুপযোগী এবং জনশূন্য (নির্জন প্রান্তর) মরুভূমি।
হে প্রভু! এ উদ্দেশ্যে (তাদের উভয়কে রেখে যাচ্ছি) যে, তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। অতএব তুমি লোকদের মনকে এ দিকে আকৃষ্ট করে দাও এবং প্রচুর ফল ফলাদি দ্বারা এদের রিযিকের ব্যবস্থা করে দাও। তারা যেন তোমার শুকরিয়া আদায় করতে পারে।’ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত- ৩৭)
জাগতিক ইতিহাসে পিতা পুত্রকে আবার পুত্রকে পিতাকে হত্যা করার ইতিহাস দুষ্প্রাপ্য নয়। গ্রিক পৌরাণিক কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, জিউস দেবতাদের রাজা হয়েছিল তার পিতা ক্রোনাসকে হত্যা করে। আর ক্রোনাস তার পিতা ইউরেনাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেবকুলের রাজা হয়েছিল।
আধুনিক যুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব তার অপর তিন ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাইকে হত্যা, অপর জন সুজাকে বার্মায় বিতাড়ন এবং বৃদ্ধ পিতা শাহজাহানকে বন্দী করে মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন।বাংলার এমন একজন শাসক ছিলেন যার পারস্যের কবি হাফিজের সাথে পত্র বিনিময় হতো।প্রথম বাঙালি মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তার বিখ্যাত রচনা ইউসুফ জুলেখা তাঁর সময়ে সম্পন্ন করেন।তাঁর সময় কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করা হয়।তাঁর রাজত্বকালেই বিখ্যাত সূফী সাধক নূর কুতুব-উল-আলম পান্ডুয়ায় আস্তানা গাড়েন। এ স্থান হতেই তিনি বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করে বেড়াতেন। এতক্ষণ যার শাসনামলের কথা বললাম তিনি হলেন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ । গিয়াস-উদ্দিন আজম শাহ (শাসনকাল ১৩৮৯-১৪১০) ছিলেন ইলিয়াস শাহী রাজবংশের তৃতীয় সুলতান। তিনিও পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ১৩৮৯ সালে বাংলার সিংহাসন অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
১৯৭০ সালে ২৩ জুলাই ২৯ বছর বয়সে কাবুস ব্রিটিশ সৈন্যদের সহায়তায় এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে তাঁর বাবা সাঈদ বিন তাইমুরকে সরিয়ে ওমানের সুলতান হন।যিনি দীর্ঘ সময় ধরে সুলতান ছিলেন।
আবার পিতাকে দীর্ঘদিন পর কাছে পাবার পর অনুভূতি যে কতটা প্রবল হয় তা ইতিহাস সাক্ষী। নাসিরউদ্দিন বুগরা খান বাংলার গভর্নর (১২৮১–১২৮৭) এবং পরবর্তীকালে বাংলার একজন স্বাধীন সুলতান (১২৮৭–১২৯১) ছিলেন। তিনি দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের পুত্র। ১২৮৭ সালে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পরে বুগরা খান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজের স্বাধীন সুলতান হিসেবে দেশ পরিচালনা শুরু করেন।
কিন্তু কায়খসরুর পরিবর্তে দিল্লি সালতানাতের উজিরে আজম সহ দিল্লির অভিজাতবর্গ নিজামুদ্দিন বুগরা খানের পুত্র মুইজউদ্দিন কায়কোবাদকে দিল্লির সুলতান নিযুক্ত করেন। কিন্তু কায়কোবাদের অদক্ষতার কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজামউদ্দিন সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। এর ফলে দিল্লিতে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। বুগরা খান দিল্লির অরাজকতা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই তিনি তার পুত্র কায়কোবাদের নীতিবোধ জাগ্রত করতে দিল্লির দিকে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। একই সময়ে, উজিরে আজম নিজামউদ্দিন তার বাবার মুখোমুখি হওয়ার জন্য মুইজউদ্দিন কায়কোবাদকেও একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। দুই সেনাবাহিনী সরযূ নদীর তীরে মিলিত হয়। কিন্তু পিতা ও পুত্র রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মুখোমুখি না হয়ে বিনাযুদ্ধেই সমঝোতায় পৌঁছান। বুগরা খান তার পুত্র মুইজউদ্দিন কায়কোবাদকে রাজকার্য পরিচালনা সম্পর্কে বিভিন্ন উপদেশ দেন এবং রাজকার্য সর্বদা সচেতন থাকার পরামর্শও দেন।
পিতার পরামর্শে কায়কোবাদ নাজিমউদ্দিনকে উজির আজমের পদ থেকে বরখাস্ত করেন এবং পিতাকে বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তারপর বুগরা খান লখনৌতিতে (বর্তমান গৌড়) ফিরে আসেন।
প্রখ্যাত সুফি কবি এবং বুগরা খানের সভাকবি আমীর খসরু এই ঘটনা নিয়ে কিরান-উস-সাদাইন (দুই তারকার মিলন) গ্রন্থ লিখে ঘটনাটিকে আজও স্মরণীয় করে রেখেছেন।
এসব ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত মহামানব ও জাগতিক ক্ষমতায় বিভোর শাসকদের পিতা পুত্রের ভালোবাসা বিচ্ছেদ ও মহামিলনের কথা জানলাম। কিন্তু সাধারণের মনে পুত্রের জন্য অনুভূতি, উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসার কমতি নেই। যাদের ভালোবাসা ও অনুভূতি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায় না। যে অনুভূতির অন্তরের গহীনে জমা ও নিঃসরণ ঘটে। পুত্রের জন্য রইল অনিঃশেষ শুভ কামনা ও ভালোবাসা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন