সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

একজন নুরসি ও তাঁর রিসালা-ই-নুর


সাঈদ নুরসি (১৮৭৭-১৯৬০) যিনি বদিউজ্জামান নামেও পরিচিততিনি ছিলেন একজন সুন্নি মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক।নুরসির জন্ম ১৮৭৭ সালে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত পূর্ব আনাতোলিয়ার বিতলিস ভিলায়েত প্রদেশের নুরস নামকগ্রামে।পিতা মির্জা আর মা নুরীর চতুর্থ সন্তান সাঈদ নুরসীদের পরিবারটি ছিল কুর্দি গোত্রভুক্ত।এই শিশুর নাম ছিল সাঈদ, মানে ভাগ্যবান। নুরসে জন্ম নিয়েছেন- তাই নুরসি। বাল্যকালে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় মুহাম্মদ এফেন্দির মাদ্রাসায়। এরপর ১৮৮৮ সালে শাইখ আমিন এফেন্দির মাদ্রাসা এবং পরে আরো বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়ন শেষে শাইখ মুহাম্মাদ জালালির কাছ থেকে শিক্ষাসনদ লাভ করেন। বদিউজ্জামানতার সম্মানসূচক খেতাববা যুগের বিশ্বয় (Wonder of the age) ইংরেজিতে বলা হতো দি মোস্ট ইউনিক অ্যান্ড সুপিরিয়র পারসন অব দ্য টাইম। তিনি ধর্মীয় বিতর্কে পারদর্শিতা দেখান।

তিরিশের দশকে তুরস্ক থেকে যখন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়, মানুষকে ধর্মচর্চা থেকে জোর করে বিমুখ করে বিস্মৃত করা হয় তাদের ঈমানি চেতনা, ধর্মীয় সঙ্কটের নিদারুণ সেই ক্রান্তিকালে উস্তাদ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি মানুষের ভেতর ঈমানি চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে এ মিশনের সূচনা করেন। প্রচলিত পীর-মুরিদি এবং সুফিজমকে তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে মানুষকে আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মশুদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট করতে এই ধারাকে উপযোগীও মনে করেননি। তাই সিলসিলাগত আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ও অভিনব পদ্ধতিতে মানুষের আত্মশুদ্ধির এক মেহনতের সূচনা করেন।

ধর্মীয় পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখায় ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের কারণে তাকে তার জীবনের অধিকাংশ সময় বন্দীদশা বা নির্বাসনে কাটাতে হয়।তার সমাজমুখি ও জনপ্রিয় কর্মকাণ্ডে সমাজের অবস্থা দ্রুতই বদলাতে থাকে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বিষয়টিকে ভালভাবে নেয়নি। যে কারণে তাকে ১৯৩০-১৯৫০ এর মধ্যে কয়েকবার জেলে যেতে হয়।অনেকে তাকে মদিনায় হিজরত করতে পরামর্শ দেন এবং বলেন, বদিউজ্জামান; সময়টা আপনার নয়। ওরা আপনাকে বিনাশ করবে।তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন—‘কী বলছেন আপনারা? সময় এখন তুরস্কে হিজরত করার। আমি যদি মদিনার অধিবাসী হতাম, তাহলে অবশ্যই আমি আতাতুর্কের এই তুরস্কে হিজরত করতাম।

সাঈদ নূরসী বলেছিলেন - আমি প্রমাণ করবো এবং দুনিয়াকে দেখাবো যে, আল-কোরআন মৃত্যুহীন এবং নিভিয়ে ফেলা যায় না এমন এক সূর্য।“I shall prove and demonstrate to the world that the Quran is an undying, inextinguishable sun." এরপর তিনি তার রিসালায়ে নুর গ্রন্থ রচনা করেন।ব্রিটিশ কলোনি সচিব গ্ল্যাডস্টোন তুর্কিদের পদানত করার ব্যাপারে বলেছিলেন, 'মুসলমানদের হাতে যদি কুরআন থাকে তবে তাদের পদানত করা যাবে না, তাদের উপর বিজয়ী হতে হলে হয় কুরআন তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে অথবা কুরআনের প্রতি তাদের ভালবাসার বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে।' এ কথার প্রতিউত্তরে নুরসি বলেছিলেন 'কুরআন অমর ও অনস্তমিত সূর্য, যা কখন মুসলমান তথা কল্যাণকামী মানুষ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।' এরপরই তিনি কুরআন ভিত্তিক আধুনিক, মানবিক ও মরমি ব্যাখ্যায় প্রবৃত হন এবং ছয় হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গবেষণা ভান্ডার গড়ে তুলেন। যা 'রিসালা-ই-নুর' নামে পরিচিত।বিশ্বের ৪৯টি ভাষায় রিসালা-ই-নুর অনূদিত হয়েছে। যেখানে মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন তিনি নতুন এক পদ্ধতিতে। ঈমানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন গবেষণার ধাঁচে। আধুনিক তুরস্কের সেকুলার ভাবাপন্ন মানুষ বিপুলভাবে আকৃষ্ট হন তাঁর এ পদ্ধতির প্রতি। বিপুলভাবে পঠিত ও চর্চিত হতে থাকে রিসালায়ে নুর গ্রন্থখানিও।'রিসালা-ই-নুর' তাকে তুর্কিদের কাছে তো বটেই পুরো পৃথিবীতে অমর করে রেখেছে।

বহুমতকে তিনি ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেননি। তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মাজহাব নিয়ে বিরোধও পছন্দ করতেন না। তিনি বলে গেছেন, ‘আমার রাস্তাই একমাত্র সঠিক ও সত্য, অন্যটি নয়কিংবা উৎকর্ষ ও সৌন্দর্য শুধু আমার তরিকাতেই আছে, অন্যটির মধ্যে নেইএমন বক্তব্য অন্যের পথ, পন্থা ও পদ্ধতিকে মিথ্যা ও বাতিল বলে ঘোষণা দেয়। এমন কথা কখনোই বলা উচিত নয়।

আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিকে ভবিষ্যতের পথ বিবেচনা করে তিনি সাধারণ বিদ্যালয়ে ধর্মীয় জ্ঞান ও ধর্মীয় বিদ্যালয়ে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন।নুরসি একটি বিশ্বাসভিত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।এই আন্দোলন তুরস্কে ইসলামের পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখে। বর্তমানে সারাবিশ্বে এর ব্যাপক অনুসারী রয়েছে। তার অনুসারীদের প্রায় "নুরজু" বা "নুর জামাত" নামে অবিহিত করা হয় । ষাটের দশকের শুরুর দিকে সাঈদ নুরসি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তাঁর তিন দশকের মেহনতে পুরো তুরস্ক জুড়ে রেখে যান রেসালায়ে নুরের লাখ লাখ একনিষ্ঠ পাঠক। রেখে যান বেশুমার অনুসারী। তাঁর ইন্তেকালের পর এরাই আঁকড়ে ধরেন তাঁর মিশনকে, এবং নুর জামাত নামে তাঁরা পুরো বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তুরস্কসহ বর্তমানে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরান, আফ্রিকার মৌরতানিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নুরসি জামাতের কার্যক্রম চলমান। তুরস্কের ইস্তাম্বুলেই মাদরাসায়ে নুর নামে পরিচালিত তাঁদের কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজারের ওপরে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন তুরস্কের অন্যান্য প্রদেশ ও শহরে এর সংখ্যা আরও বেশি। সৌদি আরবের ১০টি শহরে আছে মাদরাসায়ে নুরের কার্যক্রম।নুরসির জীবনী নিয়ে ২০১১ সালে তৈরী হয়েছে তুর্কী চলচ্চিত্র হুর আদম।

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...