একজন নুরসি ও তাঁর রিসালা-ই-নুর
তিরিশের দশকে তুরস্ক থেকে যখন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়, মানুষকে ধর্মচর্চা থেকে জোর করে বিমুখ করে বিস্মৃত করা হয় তাদের ঈমানি চেতনা, ধর্মীয় সঙ্কটের নিদারুণ সেই ক্রান্তিকালে উস্তাদ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি মানুষের ভেতর ঈমানি চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে এ মিশনের সূচনা করেন। প্রচলিত পীর-মুরিদি এবং সুফিজমকে তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে মানুষকে আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মশুদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট করতে এই ধারাকে উপযোগীও মনে করেননি। তাই সিলসিলাগত আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ও অভিনব পদ্ধতিতে মানুষের আত্মশুদ্ধির এক মেহনতের সূচনা করেন।
ধর্মীয় পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখায় ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের কারণে তাকে তার জীবনের অধিকাংশ সময় বন্দীদশা বা নির্বাসনে কাটাতে হয়।তার সমাজমুখি ও জনপ্রিয় কর্মকাণ্ডে সমাজের অবস্থা দ্রুতই বদলাতে থাকে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বিষয়টিকে ভালভাবে নেয়নি। যে কারণে তাকে ১৯৩০-১৯৫০ এর মধ্যে কয়েকবার জেলে যেতে হয়।অনেকে তাকে মদিনায় হিজরত করতে পরামর্শ দেন এবং বলেন, বদিউজ্জামান; সময়টা আপনার নয়। ওরা আপনাকে বিনাশ করবে।’ তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন—‘কী বলছেন আপনারা? সময় এখন তুরস্কে হিজরত করার। আমি যদি মদিনার অধিবাসী হতাম, তাহলে অবশ্যই আমি আতাতুর্কের এই তুরস্কে হিজরত করতাম।
সাঈদ নূরসী বলেছিলেন - “আমি প্রমাণ করবো এবং দুনিয়াকে দেখাবো যে, আল-কোরআন মৃত্যুহীন এবং নিভিয়ে ফেলা যায় না এমন এক সূর্য।”“I shall prove and demonstrate to the world that the Quran is an undying, inextinguishable sun." এরপর তিনি তার রিসালায়ে নুর গ্রন্থ রচনা করেন।ব্রিটিশ কলোনি সচিব গ্ল্যাডস্টোন তুর্কিদের পদানত করার ব্যাপারে বলেছিলেন, 'মুসলমানদের হাতে যদি কুরআন থাকে তবে তাদের পদানত করা যাবে না, তাদের উপর বিজয়ী হতে হলে হয় কুরআন তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে অথবা কুরআনের প্রতি তাদের ভালবাসার বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে।' এ কথার প্রতিউত্তরে নুরসি বলেছিলেন 'কুরআন অমর ও অনস্তমিত সূর্য, যা কখন মুসলমান তথা কল্যাণকামী মানুষ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।' এরপরই তিনি কুরআন ভিত্তিক আধুনিক, মানবিক ও মরমি ব্যাখ্যায় প্রবৃত হন এবং ছয় হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গবেষণা ভান্ডার গড়ে তুলেন। যা 'রিসালা-ই-নুর' নামে পরিচিত।বিশ্বের ৪৯টি ভাষায় রিসালা-ই-নুর অনূদিত হয়েছে। যেখানে মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন তিনি নতুন এক পদ্ধতিতে। ঈমানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন গবেষণার ধাঁচে। আধুনিক তুরস্কের সেকুলার ভাবাপন্ন মানুষ বিপুলভাবে আকৃষ্ট হন তাঁর এ পদ্ধতির প্রতি। বিপুলভাবে পঠিত ও চর্চিত হতে থাকে রিসালায়ে নুর গ্রন্থখানিও।'রিসালা-ই-নুর' তাকে তুর্কিদের কাছে তো বটেই পুরো পৃথিবীতে অমর করে রেখেছে।
বহুমতকে তিনি ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেননি। তিনি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে
মাজহাব নিয়ে বিরোধও পছন্দ করতেন না। তিনি বলে গেছেন, ‘আমার রাস্তাই
একমাত্র সঠিক ও সত্য, অন্যটি নয়’ কিংবা ‘উৎকর্ষ ও সৌন্দর্য শুধু আমার তরিকাতেই আছে, অন্যটির
মধ্যে নেই’ এমন বক্তব্য অন্যের পথ, পন্থা ও পদ্ধতিকে মিথ্যা ও বাতিল বলে ঘোষণা দেয়। এমন কথা কখনোই বলা উচিত
নয়।
আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিকে ভবিষ্যতের পথ বিবেচনা করে তিনি সাধারণ
বিদ্যালয়ে ধর্মীয় জ্ঞান ও ধর্মীয় বিদ্যালয়ে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের
পক্ষপাতী ছিলেন।নুরসি একটি বিশ্বাসভিত্তিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।এই আন্দোলন
তুরস্কে ইসলামের পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখে। বর্তমানে সারাবিশ্বে এর ব্যাপক অনুসারী
রয়েছে। তার অনুসারীদের প্রায় "নুরজু" বা "নুর জামাত" নামে
অবিহিত করা হয় । ষাটের দশকের শুরুর দিকে সাঈদ নুরসি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তাঁর
তিন দশকের মেহনতে পুরো তুরস্ক জুড়ে রেখে যান রেসালায়ে নুরের লাখ লাখ একনিষ্ঠ পাঠক।
রেখে যান বেশুমার অনুসারী। তাঁর ইন্তেকালের পর এরাই আঁকড়ে ধরেন তাঁর মিশনকে, এবং নুর জামাত নামে তাঁরা পুরো বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তুরস্কসহ
বর্তমানে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরান, আফ্রিকার মৌরতানিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নুরসি জামাতের কার্যক্রম চলমান।
তুরস্কের ইস্তাম্বুলেই মাদরাসায়ে নুর নামে পরিচালিত তাঁদের কেন্দ্রের সংখ্যা এক
হাজারের ওপরে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন তুরস্কের অন্যান্য প্রদেশ ও শহরে এর সংখ্যা
আরও বেশি। সৌদি আরবের ১০টি শহরে আছে মাদরাসায়ে নুরের কার্যক্রম।নুরসির জীবনী নিয়ে
২০১১ সালে তৈরী হয়েছে তুর্কী চলচ্চিত্র হুর আদম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন