জুবায়দা ও নহর-ই-জুবায়দা




আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে নহর শব্দটির সাথে জুবায়দা নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ইতিহাস ও কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, আব্বাসীয় শাসনামলে ক্ষমতাধর নারী ছিলেন জুবায়দা।জুবায়দা বিনতে জাফর ইবনে মনসুর আব্বাসীয় রাজকন্যাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিলেন ।হারুন আর-রশিদের স্ত্রী এবং দ্বিতীয়ত চাচাতো বোন ছিলেন। তিনি বিশেষত বাগদাদ থেকে মক্কা ও মদীনা যাওয়ার পথে মুসলিম হজযাত্রীদের জন্য জল সরবরাহকারী কূপ, জলাধার এবং কৃত্রিম পুলের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। যাঁর সম্মানে নহর-ই-জুবায়দানামকরণ করা হয়েছিল।তিনি ছিলেন যেকোনো ভালো কাজে আগ্রহী আর অগ্রগামী। সমসাময়িক দুনিয়ায় তার মতো বিদুষী, সুন্দরী, পরোপকারী ও বুদ্ধিমতী নারী দ্বিতীয়জন ছিলেন না। তিনি কেবল উচ্চগুণসম্পন্ন নারীই ছিলেন না, ছিলেন একজন কবিও।
মরুপ্রবণ মক্কায় পানির তেমন উৎস ছিল না। তাই সবসময় পানি সঙ্কট ছিল তীব্র। ফলে সেকালে হজযাত্রীরা পানির অভাবে অসহনীয় কষ্ট পেতেন। ১৯৩ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদের সময়ে পানির অভাব এতই তীব্র হয়েছিল যে, এক বালতি পানি ২০ দিরহামে বিক্রি করা হতো। খলিফা হারুন অর রশিদের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনাও হজযাত্রীদের পানির অভাব থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। ৮০২ হিজরিতে সম্রাজ্ঞী জুবায়দা, পুত্রদ্বয় আমীন ও মামুনকে নিয়ে খলিফা হজ পালনে মক্কায় যান। এ সময় জুবায়দা হজ উপলক্ষে মক্কায় আসা হজযাত্রীদের পানীয় জলের কষ্ট দূর করার লক্ষ্যে এক লাখ দিনার ব্যয়ে পঁচিশ মাইল দূর থেকে একটি খাল খনন করে পবিত্র মক্কা নগরীতে পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন।
ঘটনাটি চমকপ্রদ। পবিত্র মক্কায় পানির কষ্ট দেখে জুবায়দা এতই ব্যথিত হন যে, এর অবসানে একটি খাল খননের সিদ্ধান্ত নেন। খালটি এমন সময়ে খনন করা হয়েছিল, যখন আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ইবনে খলিকানের মতে, তার ইঞ্জিনিয়াররা যখন ব্যয় সম্পর্কে তাকে সতর্ক করেছিলেন।তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে- প্রযুক্তিগত অসুবিধাগুলির কথা কখনই মনে করবেন না, তিনি এই কাজটি সম্পাদন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
শত শত বছর খালটি থেকে ওই অঞ্চলের মানুষ পানির চাহিদা মিটিয়েছে। সেকালে এই খাল খনন প্রকৌশলবিদ্যার এক অসাধারণ কীর্তি। রানী জুবায়দা খাল খননের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বিখ্যাত সব প্রকৌশলী ও জরিপকারীকে ডেকে পাঠান। পুরো এলাকা জরিপের পর তারা সিদ্ধান্ত দিলেন হুনায়ন (পবিত্র মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকা) উপত্যকার পার্বত্য ঝর্ণা যা সেখানকার অধিবাসীদের খাবার পানির প্রয়োজন মিটাত, সেখান থেকে খালটি খনন করে আনা হবে। হজ পালন শেষে বাগদাদে ফিরে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই জুবায়দার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। গভীর মনোনিবেশ করলেন শুধু এই কাজে।
মক্কার মরুপ্রবণ অঞ্চলটি কঙ্করময়, অনুর্বর, শুষ্ক এবং সেখানকার আবহাওয়া উষ্ণ। ফলে ভূপৃষ্ঠে একটি খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ছিল কঠিন। তাই প্রকৌশলীরা টানেলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ খাল খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, জনগণ যাতে এ খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এর জন্য কিছু দূর অন্তর অন্তর ভূপৃষ্ঠে পানির কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সম্রাজ্ঞী জুবায়দার নির্দেশে হুনায়ন উপত্যকার ঝর্ণাসহ পানির উৎসগুলো বিপুল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়া হয়েছিল। পর্বতের মধ্য দিয়ে পানি আনা ছিল একটি কঠিন কাজ। যাতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বিপুল লোকবল এবং প্রচুর অর্থের। পর্বত কাটার জন্য, অনুর্বর এবং কঙ্করময় পাহাড় খনন করতে প্রয়োজন হয়েছিল বহু বিশেষজ্ঞের। কিন্তু কোনো কিছুই জুবায়দার দৃঢ়প্রতিজ্ঞাকে ক্ষুন্ন করতে পারেনি। রানী বলেছিলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয় কোদাল এবং শাবলের প্রতিটি আঘাতের জন্য আমি এক দিরহাম অর্থ পরিশোধ করব।’ এই বলে তিনি কাজ শুরু করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। বেশ কয়েক বছর টানা কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে জাবালে রামা তথা দোয়ার পর্বত পেরিয়ে এ নহর আরাফাতে নিয়ে আসা হয়। তারপর নিয়ে আসা হয় মুজদালিফা এবং মিনায়। হুনায়ন উপত্যকার ঝর্ণার পানি এবং পথে অন্য উৎসগুলো এ নহর অভিমুখে এনে সংযুক্ত করা হয়। এ নহরের মাধ্যমে পানি সরবরাহের মধ্য দিয়ে হজ পালনকারী এবং মক্কার জনগণ খাবার পানির সঙ্কটমুক্ত হন। মানবদরদি ও বিশাল অন্তরের রানী জুবায়দার জীবনের এটি ছিল বিশেষ কীর্তি। ইতিহাসে এই খালই ‘নাহর-ই-জুবায়দা’ নামে প্রসিদ্ধ।
২৪৫ হিজরিতে পবিত্র মক্কা এলাকায় ভূমিকম্প হয়েছিল। ফলে নহর-এ-জুবাইদার বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দেয়। তৎকালীন খলিফার নির্দেশে তাত্ক্ষণিকভাবে তা মেরামত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকজন শাসক নহর-এ-জুবাইদার উন্নয়ন সাধন করেছিলেন। কালের প্রবাহে ব্যবস্থাপনা ও মেরামতের অভাবে নহর-এ-জুবাইদা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক শতাব্দী পর পানির চাহিদা মেটানোর জন্য নতুন নতুন পর্যাপ্ত পানির উৎস তৈরি করা হয়। পরে নহর-এ-জুবাইদার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
১২৯৫ হিজরিতে তৎকালীন শাসকরা নহর-এ-জুবাইদা ব্যবস্থাপনা ও মেরামত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৩৪৪ হিজরিতে উজানে নুমান উপত্যকায় বন্যায় খালটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে তিন মাসের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাদশাহ আবদুল আজিজ শাসনভার গ্রহণ করার পর নহর-এ-জুবাইদা সংস্কার করেন। কিন্তু ১৪০০ হিজরির প্রথম দিকে নানা কারণে নহর-এ-জুবাইদার পানিপ্রবাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায় এবং তা আর পুনঃসংস্কার করা হয়নি। এখনো হজ বা ওমরাহ পালনকারীরা মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের দিকে ঘুরলে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নির্মিত এই নহর-এ-জুবাইদা দেখতে পাবেন।
জুবায়দার ধৈর্য, প্রজ্ঞার পরিচয় এই একটি কথা থেকেই বোঝা যায়। আল-মামুনের খেলাফতের মধ্যেই এই বিদুষী নারী ৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

ইন্টারনেট অবলম্বনে


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল