সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পম্পেই নগরী



পম্পেই নগরী হল একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত রোমান ছোট নগর বা শহর; ইতালির কাম্পানিয়া অঞ্চলের আধুনিক নেপলসের (নাপোলি) কাছে পম্পেই ইউনিয়নে এর অবস্থান। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নেয়গিরির দুই দিনব্যাপী সর্বনাশা অগ্নুৎপাতে পম্পেই নগরী সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি ধ্বংস করেছি কত জনপদ, যার অধিবাসীরা ছিল জালিম (পাপাচারী) এবং তাদের পরে সৃষ্টি করেছি অন্য জাতি।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১১)সেই সব অনুল্লিখিত জাতি ও জনপদের একটি ইতালির পম্পেই নগরী। পৃথিবীর প্রাচীনতম অভিজাত জনপদগুলোর একটি ছিল এই পম্পেই নগরী। সে সময় প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি ছিল নগরটি। এটি ছিল দুই হাজার বছরের পুরনো একটি অভিজাত শহর। ইতালির তৎকালীন রাজা ওসকান খ্রিস্টপূর্ব ছয় থেকে সাত শতাব্দীর দিকে এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। এরপর ইউরোপে সংঘটিত বিভিন্ন পর্যায়ের যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে খ্রিস্টপূর্ব ৮০ শতাব্দীর দিকে এই শহরটিতে রোমান সাম্রাজ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। আর সেখানে গড়ে ওঠে রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম শিল্পবন্দর। তখন থেকেই রোমানরা সেখানে বসবাস শুরু করে। ক্রমান্বয়ে সেটি হয়ে ওঠে সমকালীন বিশ্বের অন্যতম বিত্ত-বৈভব আর অভিজাত নগরী। রোমান আর গ্রিক বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয় এই শহর। ভূমধ্যসাগরের উপত্যকায় ভিসুভিয়াস পাহাড়ের পাদদেশে নেপলস শহরের পাশেই গড়ে উঠেছিল শহরটি।
শহরটি বাণিজ্যনগরীর পাশাপাশি ধীরে ধীরে সারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম বিনোদননগরীর মর্যাদাও অর্জন করতে সক্ষম হয়। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিপুল সমাহার কাজে লাগিয়ে রোমানরা এটিকে অপরূপ সজ্জায় সজ্জিত করতে পেরেছিল। গড়ে উঠেছিল নানা ধরনের বিনোদনকেন্দ্র, যার টানে সমগ্র পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসু অভিজাত সমাজ ভিড় করতে থাকল সেখানে। সবাই অবসর কাটানোর জন্য ছুটে যেত প্রাচীনকালের আধুনিক সভ্যতার সব ধরনের চিত্তরঞ্জনের সমাহার থাকা এই প্রাণচঞ্চল শহরে। বণিক ও পর্যটকদের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছিল অত্যাধুনিক দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা আর প্রমোদকেন্দ্র। সহায়-সম্পদ আর বিত্ত-বৈভবের অভাব ছিল না পম্পেইবাসীর। কিন্তু এত সব নিয়ামতের মধ্যে ডুবে থেকেও পম্পেইবাসী ভুলে গেল মহান স্রষ্টাকে। ভুলে গেল তৎকালীন আসমানি ধর্মকে। উদাসীন হলো স্রষ্টার আরোপ করা বিধি-নিষেধের প্রতি। ফলে তারা লিপ্ত হলো নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপে। নিজেদের চিত্তরঞ্জনের জন্য উদ্ভাবন করল ঘৃণ্যতম সব পন্থা। খোদা প্রদত্ত নির্দেশাবলি অস্বীকার করে নানা ধরনের অমানবিক, হিংস্র আর নোংরা কর্মকাণ্ডে দিন দিন ডুবে যেতে থাকে পম্পেইবাসী।

নিছক বিনোদনের জন্য জনসমাগম করে, বিপুল জনতার সামনে তারা মানুষ ও পশুতে, কখনো বা মানুষে-মানুষে যুদ্ধ বাধিয়ে দিত। এই মানুষ ও পশু বা মানুষে-মানুষে একে অপরকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আঘাত করে যতক্ষণ রক্তাক্ত করে কোনো একজনকে চিরতরে দুনিয়া থেকে বিদায় না করত, ততক্ষণ পর্যন্ত চলত এই বর্বরোচিত অমানবিক খেলা। আর এই মরণখেলা উপভোগ করত সে সময়ের রোমান অভিজাত শ্রেণির দর্শকরা। মানব হন্তারক সেজে সেখানে তারা খুঁজত চিত্তবিনোদন।
যৌনতায় ছিল এরা অন্ধ। শুধু যৌনকার্যের জন্য প্রতিটি বাড়িতে নির্মিত হতো আলাদা স্থাপনা। বাড়িঘরের দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কিত হতো নগ্ন পর্ণচিত্র। নিজেরা তো যৌনতায় ডুবে থাকতই, সেই সঙ্গে নিজের ছেলে-মেয়েদের দিয়েও বণিক ও পর্যটকদের যৌন বিনোদনের ব্যবস্থা করতে তারা পিছপা হতো না। এমনকি তারা নিজেরা পশু-পাখির সঙ্গেও যৌন বিকৃতির পিপাসা মেটাত।
এভাবেই দিন দিন তৎকালীন আসমানি ধর্ম খ্রিস্টবাদ থেকে বিচ্যুত হতে থাকে তারা। ক্রমান্বয়ে শহর ছেড়ে চলে যেতে থাকেন সব ধর্মযাজকরা। ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় উজ্জীবিত ইউরোপের কনজারভেটিভ ধর্মীয় সম্প্রদায় পম্পেই শহর পরিভ্রমণ থেকে বিমুখ হতে শুরু করে। এমনই এক অমানবিক, ঘৃণ্যতম ও বর্বরোচিত সমাজব্যবস্থা যখন সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, তখনই নেমে এলো মহান স্রষ্টার ক্রোধের আগুন। জীবন্ত মমিতে পরিণত হলো অনাচার আর পাপাচারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত থাকা মানুষগুলো।
৭৪ খ্রিস্টাব্দের এক ভরদুপুর। আত্মহারা খোদাবিমুখ পম্পেই অধিবাসীরা আনন্দ-উল্লাসে নিজেদের মত্ত রেখেছিল। এমনই সময়ে নেমে এলো খোদায়ি গজব। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুযায়ী, শহরের পাশে অবস্থিত ভিসুভিয়াস পর্বতের আগ্নেয়গিরিতে শুরু হয় বিরাট ধরনের অগ্ন্যুৎপাত, যাতে পম্পেই শহরসহ শহরের দুই লাখ অধিবাসী দিনদুপুরে মাত্র অল্প কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে অন্তত ৭৫ ফুট অগ্নির লাভা আর ছাইভস্মের নিচে বিলীন হয়ে যায়। তাত্ক্ষণিক জীবন্ত কবর রচিত হয় শহরের সব মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদসম্ভারের। উল্লেখ্য, ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে আবারও এই আগ্নেয়গিরিটি বিস্ফোরিত হয়েছিল, যাতে অন্তত ১৯ হাজার মানুষ নিহত হয়। কিন্তু সেটি ৭৪ খ্রিস্টাব্দের বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ছিল না, যা টানা ১৯ ঘণ্টা পর্যন্ত অগ্নিবৃষ্টি বর্ষণ করেছিল। আর ভূমধ্যসাগরের সাত মাইল ভেতর পর্যন্ত অগ্নি-লাভা ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে তখন এর অগ্নি-লাভার তীব্রতা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের চেয়েও শক্তিশালী ছিল। ওপরের দিকে অন্তত ৯ মিটার পর্যন্ত অগ্নস্ফুুুিলিঙ্গ ধাবিত হয়েছিল। এর পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত শত শত বছর ধরে আধুনিক মানবসভ্যতার অগোচরেই থেকে যায় এই অভিশপ্ত শহরটি। কিন্তু ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে কিছু অ্যামেচার আর্কিওলজিস্ট সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন ধ্বংস হয়ে যাওয়া পম্পেই নগরী। শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে ধ্বংসলীলা থেকে মমি হয়ে থাকা মৃতদেহ আর অভাবনীয় সব স্থাপনা উদ্ধারের মহাযজ্ঞ। আর ধীরে ধীরে সেখানে বাড়তে থাকে উত্সাহী জনতার আনাগোনা। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, দুই হাজার বছরের পুরনো এই ধ্বংসলীলা থেকে এখনো অবিকৃত অবস্থায় তাদের দেহগুলো পাওয়া যাচ্ছে। যে যেভাবে ছিল, অবিকল সেভাবেই পড়ে আছে। মহান স্রষ্টা আগত প্রজন্মকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য তাঁর নিদর্শন নৈপুণ্যতায় এসব মৃতদেহকে বছরের পর বছর মাটির নিচে সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন। কালের বিবর্তনে কয়েক হাজার বছরের পুরনো সেই পর্যটনকেন্দ্র আবার পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চির উন্নত সেই পম্পেই নগরী ইতিহাসের অভিশপ্ত নগরী হয়ে মানুষের শিক্ষা গ্রহণের পাঠশালা হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে ইতালি সরকার বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই নগরীকে ঐতিহাসিক জাদুঘরে রূপ দিচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...