পৃথিবী শাসনকারী চার শাসক
হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র সুলাইমান (আ.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। হিব্রু বাইবেল অনুসারে, তিনি ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজা। তার জন্ম আনুমানিক ১০১১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এবং মৃত্যু আনুমানিক ৯৩১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে । সুলাইমান (আ.) ছিলেন মহান আল্লাহর প্রেরিত একজন নবী। এ ছাড়া তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় ও অনুপম সাম্রাজ্যের অধিকারী। মহান আল্লাহ তাঁকে শুধু সমগ্র পৃথিবীর নয়, বরং জিন জাতি, পক্ষীকুল ও বায়ুর ওপরও আধিপত্য দান করেছিলেন।ইমাম বাগাভী ইতিহাসবিদগণের বরাতে বলেন, সুলায়মান (আঃ)-এর মোট বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তের বছর বয়সে রাজকার্য হাতে নেন এবং শাসনের চতুর্থ বছরে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তার রাজত্ব কাল ছিল প্রায় ৯৭০ থেকে ৯৩০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী। তবে তিনি কত বছর বয়সে নবী হয়েছিলেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। শাম ও ইরাক অঞ্চলে পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের তিনি বাদশাহ ছিলেন। তাঁর রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিল। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সূরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
পিতা দাউদ (আ.)-এর সাম্রাজ্যের সীমানা সুলাইমান (আ.) আরো বিস্তৃত করেন। পবিত্র কোরআনে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি উল্লেখ করতে ‘মাশারিকাল আরদ ওয়া মাগারিবিহা’ তথা পৃথিবীর পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল বোঝানো হয়েছে।পবিত্র কোরআনে (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮১) সুলাইমানের অধীন ভূমিকে বরকতময় অঞ্চল হিসেবে বিধৃত করেছে। ব্যাখ্যাকাররা তা শামের (সিরিয়া) পবিত্র ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে উত্তরদিকে প্রাচীন ‘ইন্তাকিয়া’ কিংবা বর্তমান এশিয়া মাইনর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকতে পারে সুলাইমান (আ.)-এর রাজ্য। দক্ষিণের সীমান্ত সম্ভবত সৌদি আরবের তায়েফ এলাকার ‘ওয়াদি সুলাইমান’ নামক পাহাড়। কোনো কোনো ব্যাখ্যাকার যাকে কোরআনে উল্লিখিত ‘ওয়াদি আন-নামল’ বা ‘পিঁপড়ার উপত্যকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য আরো দক্ষিণে অবস্থিত সাবার রানি বিলকিসের অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত হলে সুলাইমান (আ.) এ রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা বর্তমান ইয়ামেন পর্যন্ত বিস্তৃত।
সুলাইমান (আ.) এ বিস্তৃত সাম্রাজ্যে চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর সাম্র্রাজ্যকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাম্র্রাজ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মানব, দানব, জিন, পশু-পাখি সব কিছুর ওপর তাঁর আধিপত্য ছিল। (সুরা নামল, আয়াত : ১৭; সুরা ছোয়াদ, আয়াত : ৩৭-৩৮)। জিনদের সাহায্যে তিনি অসাধারণ শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যের উদ্ভাবন করেন। (সুরা সাবা, আয়াত : ১২-১৩) আল্লাহর নির্দেশে বাতাস তাঁর বশীভূত ছিল। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৮১)দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি জিনদের সাহায্যে বিরাট বিরাট স্থাপত্য কর্ম গড়ে তুলেছিলেন। লৌহের পাশাপাশি তিনি তামাকে শিল্পকর্মে ব্যবহার করতেন। পিতা দাউদকে (আ.) লৌহ গলানোর মুজিজা ও পুত্র সুলাইমানকে তামা গলিয়ে ধাতু তৈরির মুজিজা প্রদান করা হয়। (তাফসিরে কুরতুবি) এত বিশাল ক্ষমতা ও প্রাচুর্যপূর্ণ সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও তিনি রাজকোষ থেকে কোনো ভাতা-বেতন গ্রহণ করতেন না। টুকরি বানিয়ে তা বিক্রি করে তার উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর রাজ্যের ন্যায়বিচার লোককথা হয়ে সারা দুনিয়ায় আজও মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হয়। জিনদের মাধ্যমে বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ তাঁর অমর কীর্তি। কোরআনে বিধৃত তাঁর ইন্তেকালের দৃশ্য খুব-ই বিস্ময়কর। (সুরা সাবা, আয়াত : ১৪)
জুলকারনাইন
জুলকারনাইন কুরআনে উল্লিখিত একজন ব্যক্তি। কুরআনের সুরা কাহাফে জুলকারনাইন নামটি উল্লিখিত আছে।জুলকারনাইন কে ছিলেন, কোন যুগে ও কোন দেশে ছিলেন এবং তার নাম জুলকারনাইন হল কেন? জুলকারনাইন নামকরণের হেতু সম্পর্কে বহু উক্তি ও তীব্র মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। কেউ বলেন,তার মাথার চুলে দুটি গুচ্ছ ছিল। তাই জুলকারনাইন (দুই গুচ্ছওয়ালা) আখ্যায়িত হয়েছেন। কেউ বলেন,পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করার কারণে জুলকারনাইন খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। কেউ এমনও বলেছেন যে, তার মাথায় শিং-এর অনুরূপ দুটি চিহ্ন ছিল। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তার মাথার দুই দিকে দুটি ক্ষতচিহ্ন ছিল।(ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর) ‘তাফহিমুল কোরআন’ গ্রন্থে এসেছে, জুলকারনাইন সম্পর্কে কোরআন থেকে চারটি কথা জানা যায়। এক. তাঁর ‘শিংওয়ালা’ উপাধি সম্পর্কে ইহুদিরা জানত। দুই. তাঁর বিজয়াভিযান পূর্ব থেকে পশ্চিমে পরিচালিত হয়েছিল এবং উত্তর-দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হয়েছিল। তিন. তিনি ইয়াজুজ মাজুজের হাত থেকে রক্ষার জন্য কোনো পার্বত্য গিরিপথে একটি মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করেন। চার. তিনি আল্লাহর আনুগত্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন।আধুনিক যুগের গবেষক ও পন্ডিতদের মতে কুরআনে উল্লিখিত জুলকারনাইনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সম্ভাব্য ৩ টি চরিত্র নির্দেশ করা হতে পারে , যারা হলেন ;আলেকজান্ডার ,সাইরাস দি গ্রেট, হিমায়ার সাম্রাজ্যের একজন শাসক।ইবনে হিশাম বলেছেন, তাঁর নাম সিকান্দার।তাফসিরবিদ আবু হাইয়্যান (রহ.) তিনি লিখেছেন, ‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোরআনে বর্ণিত গুণাবলির অধিকারী সিকান্দার ছাড়া আর কেউ নেই।’ (আলবাহরুল মুহিত-৭/২২০)।প্রাচীন তাফসিরবিদদের মধ্যে ইমাম রাজি (রহ.)-এর মতে, জুলকারনাইনের প্রকৃত নাম সিকান্দার, যিনি আলেকজান্ডার নামে পরিচিত। তিনি দারা ইবনে দারাকে একাধিকবার পরাজিত করেছেন। ইমাম রাজি (রহ.) লিখেছেন, ‘অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে জুলকারনাইন হলেন বাদশাহ সিকান্দার ইবনে ফিলিবুস ইউনানি।’ (আততাফসিরুল কাবির : ২১/৪৯৩)।ইমাম কুরতুবি (রহ.) ইবনে ইসহাকের বরাতে উল্লেখ করেছেন, ‘জুলকারনাইন ছিলেন মিসরের অধিবাসী। তাঁর নাম মিরজবান ইবনে মারদুবাহ আল ইউনানি। তিনি ইউনান বিন ইয়াফেস বিন নূহ (আ.)-এর সন্তান।(তাফসিরুল কুরতুবি- ১১/৪৫)।
হিফজুর রহমান (রহ.) তাঁর ‘কিসাসুল কোরআন’ গ্রন্থে বলেছেন, জুলকারনাইন হলেন ইরানের বাদশাহ খসরু।কুরআনের তাফসিরকারীদের কারো কারো মতে তিনি একজন নবী ছিলেন। কুরআন শরীফের সূরা কাহাফের আয়াত নম্বর ৮৩-১০১ অংশে জুলকারনাইন সম্পর্কিত বর্ণনা আছে। নবী হিসেবে জুলকারনাইনের নাম উল্লেখ নেই।কিন্তু তিনি নবী ছিলেন না এমনটিও বলা হয়নি।জুলকারনাইনের ঘটনা সম্পর্কে কুরআনুল করীম যা বর্ণনা করেছে, তা এই, তিনি একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন এবং পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশসমূহ জয় করেছিলেন। এসব দেশে তিনি সুবিচার ও ইনসাফের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাকে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বপ্রকার সাজ-সরঞ্জাম দান করা হয়েছিল। তিনি দিগ্বিজয়ে বের হয়ে পৃথিবীর তিন প্রান্তে পৌছেছিলেন- পাশ্চাত্যের শেষ প্রান্তে, প্রাচ্যের শেষ প্রান্তে এবং উত্তরে উভয় পর্বতমালার পাদদেশ পর্যন্ত। এখানেই তিনি দুই পর্বতের মধ্যবর্তী গিরিপথকে একটি থেকে এলাকার জনগণ নিরাপদ হয়ে যায়।আধুনিক যুগের মুফাসসিরগণ বিশেষ করে মওলানা আবুল কালাম আজাদ যিনি জুলকারানাইনের স্বরূপ ও প্রকৃতত্ব উদ্ঘাটনের জন্য যে গবেষণা করেছেন তা প্রশংসাযোগ্য।তার গবেষণার সারমর্ম হল
(ক) জুলকারানাইন সম্বন্ধে কুরআন পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, তিনি এমন এক বাদশাহ ছিলেন যাকে আল্লাহ প্রচুর পার্থিব উপকরণ ও উপাদান দান করেছিলেন। (খ) পূর্ব ও পশ্চিমের দেশসমূহকে জয় করে এমন এক পাহাড়ী রাস্তায় পৌছলেন যার অন্য দিকে ইয়াজূজ-মা’জূজ জাতি বাস করে। (গ) সেখানে তিনি ইয়াজূজ-মাজুজের রাস্তা বন্ধ করার জন্য একটি মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করেন। (ঘ) তিনি ন্যায়পরায়ণ, আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী সম্রাট ছিলেন। (ঙ) তিনি প্রবৃত্তিপূজারী ও ধন-সম্পদের লোভী ছিলেন না। মওলানা আজাদ বলেন, এই সমস্ত গুণের অধিকারী একমাত্র পারস্যের সেই সম্রাট যাকে ইউনানী (গ্রীস) ভাষায় সাইরাস, ইবরানী (হিব্রু) ভাষায় খুরাস এবং আরবী ভাষায় কাইখাসরু নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর রাজত্বকাল ৫৩৯ খ্রিষ্টপূর্ব। মওলানা আরো বলেন, ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সাইরাসের একটি মূর্তি পাওয়া গেছে, যাতে তাঁর দেহকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে, তাঁর শরীরের দু দিকে ঈগলের মত দুটি ডানা এবং ভেড়ার মত মাথায় দুটি শিং রয়েছে। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্যঃ তুরজুমানুল কুরআন ১ম খন্ড ৩৯৯-৪৩০পৃঃ) আর আল্লাহই ভালো জানেন।হযরত আলী (রা) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ জুলকারনাইন নবী বা ফিরিশতা ছিলেন না, একজন নেক বান্দা ছিলেন। আল্লাহকে তিনি ভালবেসেছিলেন, আল্লাহও তাকে ভালবেসেছিলেন। আল্লাহর হকের ব্যাপারে অতিশয় সাবধানী ছিলেন, আল্লাহও তার কল্যাণ চেয়েছেন। তাকে তার জাতির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তারা তার কপালে মারতে মারতে তাকে হত্যা করল। আল্লাহ তাকে আবার জীবিত করলেন, এজন্য তার নাম হল জুলকারানাইন । (মুখতারা- ৫৫৫, ফাত্হুল বারী- ৬/৩৮৩)।
নমরুদ
নমরুদ ইবরাহিম (আ.)-এর সময়ে পৃথিবীর বাদশাহ ছিল। সে ছিল পৃথিবীর চারজন বড় বড় শাসকের অন্যতম। নমরুদ প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করেছে। পবিত্র কোরআনে তার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে সে-ই সর্বপ্রথম রাজমুকুট পরিধান করেছে এবং নিজেকে খোদা দাবি করেছে। ইতিহাসবিদ ইবনে আসিরের বর্ণনা মতে, নমরুদের বংশপরম্পরা এমন : নমরুদ বিন কিনআন বিন কুশ বিন হাম বিন নূহ (আ.)। নমরুদ শব্দটির উৎপত্তি মূলত ‘নমর ও উদ’ বা ‘নমরা ও উদু’ শব্দ দুটি থেকে, যার অর্থ হচ্ছে জাজ্বল্যমান আলো। কারো কারো মতে, আবার এ নামের অর্থ বিদ্রোহী, অর্থাৎ খোদার বিরুদ্ধে দ্রোহিতার কারণে তাকে এ নামে ডাকা হতো। এর আরো একটি অর্থ হলো বাঘিনী। আরবের কিংবদন্তি অনুযায়ী নমরুদকে বাল্যকালে এক বাঘিনী স্তন্য পান করিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা নমরুদকে আল-জব্বার বা চরম স্বেচ্ছাচারী হিসেবে বিবেচনা করে। যার স্বেচ্ছাচারিতা তার শক্তি, ক্ষমতা ও দম্ভের প্রকাশভঙ্গি ছিল।’
নূহ (আ.)-এর মৃত্যুর পরের বছর মিসরে ৪২টি রাজ্যের রাজ্যপতিদের একটি সম্মেলন হয়, যেখানে নমরুদ রাজার রাজা (কিং অব কিংস) উপাধিতে ভূষিত হয়। এই খ্যাতি ও সম্মানের শিখরে পৌঁছে তার মানসিকতার পরিবর্তন আসে এবং নিজেকে দেবতা বলে দাবি করে এবং তার প্রার্থনা করার আদেশ দেয়, আর তখন থেকেই প্রজারা তাকে উপাস্যরূপে তার পূজা ও অর্চনা শুরু করে।
হজরত ইবরাহিম (আ.) ১০ বছর সবার আড়ালে এক গুহায় বসবাস করতেন। হয়তো নির্জনে বসবাস করার জন্য বাল্যকাল থেকেই হজরত ইবরাহিম (আ.) প্রকৃতি এবং স্রষ্টাকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছিলেন। অবশেষে তিনি আসল স্রষ্টাকে চিনতে পারেন। আর তাই তাঁর গোত্রের লোকদেরকে দেব-দেবীর অসারত্ব দেখিয়ে দিতে সেসব মূর্তি ভেঙে দেন এবং বলেন যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না, তারা তোমাদের কিভাবে রক্ষা করবে।এর ফলে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে বন্দি করা হয় এবং নমরুদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘হে ইবরাহিম, তোমার রব কে?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘যিনি এক, যাঁর কোনো শরিক নেই, যিনি আরশের অধিপতি। ’ নমরুদ রেগে গিয়ে তার লোকদের বলল, ‘ওকে পুড়িয়ে ফেলো; সাহায্য করো তোমার দেবতাদের, যদি একান্তই তাদের জন্য কিছু করতে চাও। ’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৬৮) নমরুদ বলল, ‘একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করো; আর হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দাও। আর পাহারা দাও যেন তাঁর কোনো সাহায্যকারী তাঁকে সাহায্য করতে না আসে। ’লোকেরা এক জায়গায় লাকড়ি জোগাড় করে সেগুলোতে তেল ও ঘি ঢেলে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। সাত দিন পর পূর্ণ অগ্নিকুণ্ড তৈরি হলো, কিন্তু সমস্যা হলো হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করার জন্য কেউ আগুনের ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারছিল না। এ সময় ইবলিস পর্যটকের বেশে সেখানে পৌঁছে চড়কগাছ তৈরির পরামর্শ দিল। তার পরামর্শে একটা চড়কগাছ তৈরি করা হয়। এবং তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। মহান আল্লাহ আগুনকে নির্দেশ দেন—‘হে অগ্নি, তুমি হজরত ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। ’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৬৯) হজরত ইবরাহিম (আ.) ৪০ দিন পর্যন্ত অগ্নিকুণ্ডে ছিলেন। আল্লাহর হুকুমে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
মহান আল্লাহকে হত্যার উদ্দেশ্যে নমরুদ ও তার সেনাপতি প্রস্তুত হয়ে সিন্দুকে আরোহণ করে ঊর্ধ্বপানে উড়ে চলল। ঊর্ধ্ব আকাশে যখন পৌঁছাল, অর্থাৎ যেখান থেকে আকাশ বা পৃথিবীর কিছুই আর দেখা যায় না। এরপর নমরুদ তীর নিক্ষেপ করার প্রস্তুত নিল। তারপর একের পর এক তারা তীর ওপরের দিকে নিক্ষেপ করল। সে সময় মহান আল্লাহ হজরত জিবরাইল (আ.)-কে বলেন, ‘আমার এই বান্দা যেন নিরাশ না হয়। ’
মহান আল্লাহর কথা শুনে হজরত জিবরাইল (আ.) তীরের মাথায় রক্ত লাগিয়ে তা ফেরত পাঠাল, যাতে নমরুদ বুঝতে পারে যে সে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর খোদাকে ‘হত্যা’ করতে পেরেছে। তীর নিক্ষেপ শেষ হলে নমরুদ পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে।
মাটিতে অবতরণ করার পর নমরুদের রক্ষীরা নিক্ষিপ্ত তীরগুলো কুড়িয়ে নিয়ে এলো। যেগুলো পাওয়া গেল তার সবই ছিল রক্তরঞ্জিত। নমরুদ রক্তমাখা তীরগুলো দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল এবং বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই আমরা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর খোদা এবং স্বর্গের বাসিন্দাদের হত্যা করতে সমর্থ হয়েছি এবং তার সাক্ষ্য বহন করে তীরে লেগে থাকা রক্তই। ’
নমরুদ আল্লাহর বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিল। হজরত ইবরাহিম (আ.) দূরে আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। দূরে কালো রঙের একটা মেঘ দেখা যাচ্ছিল, যখন সেটা কাছে চলে এলো, লাখ লাখ মশার গুনগুন শব্দে ময়দান মুখরিত হলো। কিন্তু নমরুদ অবজ্ঞার সুরে বলল, এ তো মশা! তুচ্ছ প্রাণী, তা-ও আবার নিরস্ত্র। এ সময়ের মধ্যে প্রত্যেক সৈন্যের মাথার ওপর মশা অবস্থান নিল। অতঃপর তাদের বুঝে ওঠার আগেই মশাগুলো তাদের নাক দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করল। তারপর দংশন করা শুরু করল। সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তীরন্দাজরা ঊর্ধ্বে তীর নিক্ষেপ আর পদাতিক সেনারা নিজেদের চারপাশে অন্ধের মতো তরবারি চালাল, যার ফলে একে অপরকে নিজেদের অজান্তেই আহত বা নিহত করে ফেলল।
মশার সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে নমরুদ পালিয়ে প্রাসাদে চলে এলো। এ সময় একটি দুর্বল লেংড়া মশা তাকে তাড়া করল এবং কিছুক্ষণ মাথার চারপাশে ঘুরে নাসিকাপথে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ল। এরপর মগজে দংশন করা শুরু করল। নমরুদ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উন্মাদের মতো প্রাসাদে প্রবেশ করল এবং যন্ত্রণায় দিশাহারা হয়ে পাদুকা খুলে নিজের মাথায় আঘাত করতে শুরু করল। অবশেষে মাথায় মৃদু আঘাত করার জন্য একজন সার্বক্ষণিক কর্মচারী নিযুক্ত করল নমরুদ।
সুদীর্ঘ ৪০ বছর তাকে এই দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। অবশেষে মাথার আঘাতের ব্যথায় নমরুদের মৃত্যু হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, পৃষ্ঠা. ৬৮৬)
বখতে নছরের
বখতে নছরের দৈহিক বিকৃতি বা বিবর্তন নজিরবিহীন। প্রথমে তার বিকৃতি ঘটে সিংহের আকারে। তাই হিং- জন্তুদের রাজা হয়। দ্বিতীয়বার সে শকুনের রূপ ধারণ করে। তাই সে বিহঙ্গ (পাখি) কূলের রাজা হয়। অতঃপর সে বলদ বা ষাঁড় এ রূপান্তরিত হয়। এজন্য তাকে গবাদী পশুর রাজা বলা হয়। এভাবে বখতে নছর মানুষের রূপ হতে লাগাতার সাত বার নানা রূপে রূপান্তরিত হতে থাকে। কিন্তু তার সকল দেহরূপে মানুষের অন্তর রূপ অক্ষু্ণ্ণ ছিল। একারণে সে সকল আকারে মানবীয় জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করতে থাকে এবং তখন পর্যন্ত তার রাষ্ট্র কায়েম ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তাকে মানবীয় দেহ কাঠামোতে পরিবর্তন করেন এবং তার আত্মাও ফিরিয়ে দেন। এরপর বখতে নছর লোকদেরকে তওহীদে এলাহীর আহবান জানায়। তখন সে এই কথাও প্রচার করতে থাকে আল্লাহ ব্যতীত সকল মা’বুদ বাতিল।
বখতে নছরের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। কারো কারো মতে, মৃত্যুর পূর্বে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। অর্থাৎ ঈমান এনেছিল। অন্যান্যদের মতে, বখতে নছর বহু নবী হত্যাকারী, ‘বায়তুল মুকাদ্দাছ’ (মস্জিদ এ আকসা) ধ্বংসকারী এবং সেখানে বিদ্যমান পবিত্র গ্রন্থাবলীতে অগ্নি সংযোগকারী। আল্লাহ’র গজব তার উপর নাযিল হয়। তার তওবাও কবুল হয়নি। বখতে নছর সম্পর্কে আরও বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে দ্বিতীয়বার আসল সুরত ফিরিয়ে দেন। তখন সে তার রাজত্ব ফিরে পায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন