সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আত্মহত্যার পরিসংখ্যান, কারণ, প্রতিরোধ ও ইসলাম কী বলে?

 



Suicide হচ্ছে আত্মহত্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ। লাতিন ভাষা Sui Sediur থেকে মূলত Suicide শব্দের উৎপত্তি।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যা করছেন একজন। ধারণা করা হয়ে থাকে, বিশ্বজুড়ে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন নিজের হাতেই। বাংলাদেশের চিত্রও আশঙ্কাজনক।
বেসরকারি এক সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছরে দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন আত্মহননে প্রাণ যাচ্ছে ৩৯ জনের। করোনার এই সময়ে আগের বছরের তুলনায় আত্মহত্যা বাড়ে ৪৪ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম।২০১৯-২০ করোনার সময়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। যাদের মধ্যে ২০ থেকে ৩৫ বয়সীরাই বেশি। বর্তমানে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আত্মহত্যার পরিমাণ তিন গুণ।বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে ২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৭৯ জন।জরিপে উঠে এসেছে যে, আত্মহত্যা করা ১০১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬২ জনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মোট আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ জন পুরুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের লকডাউনের সময় ঘরে বসে থাকা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা তৈরি হওয়া, পরিচিতদের সাথে সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হওয়ার মত নানা কারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা তৈরির অন্যতম প্রধান কারণ, এবং এই বিষণ্ণতাই অনেককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে।তবে এসব কারণ ছাড়াও বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মত ব্যবহার, পরিবারের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের অর্জনের খবরের সাথে নিজেদের অর্জনের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও হতাশার হার বাড়ছে - যেই বিষণ্ণতা ও হতাশা এক সময় তাদের আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে।আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিদের অনেকেই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগটি হচ্ছে বিষণ্নতা। বিষণ্নতা-রোগ মুক্ত মানুষের তুলনায় আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঝুঁকি ২০ গুণ বেশি। এ ছাড়া মাদক, উন্নত বিশ্বের গবেষণা অনুযায়ী বিশেষত অ্যালকোহলে আসক্তি একটি অন্যতম ঝুঁকি। অন্যান্য মানসিক রোগ, যেমন—সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিস-অর্ডার, বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক চাপ বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার এবং কিছু ব্যক্তিত্বের সমস্যাজনিত রোগ বিশেষত বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস-অর্ডার আক্রান্তদের মধ্যেও আত্মহত্যাপ্রবণতা সাধারণের চেয়ে বেশি।
চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, এসব আত্মহত্যার সব না হলেও বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। আগে থেকে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হলে জীবনের এ মর্মান্তিক পরিণতি এড়ানো সম্ভব। এ জন্য দরকার সচেতনতা, কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছে। গবেষণালব্ধ কার্যকর পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আত্মহত্যার মাধ্যমের সহজলভ্যতা কমানো, বয়ঃসন্ধিকালে সামাজিক ও আবেগীয় দক্ষতা উন্নয়ন, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীল ইতিবাচক ভূমিকা।আত্মহত্যা প্রতিরোধকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে থাকে।
আত্মহত্যা হচ্ছে এমন মৃত্যু; যা বান্দা কর্তৃক আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু উপেক্ষা করে নিজেই নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া, যা ইসলামে মারাত্মক অপরাধ ও হারাম কাজ। আর পরকালে এর পরিণামও ভয়াবহ।
ইসলাম কখনও আত্মহত্যার মতো কোনো অপরাধকেই সমর্থন করে না। এহেন কর্ম থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব প্রদান করে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনুল কারিমের একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন-
‘তোমরা নিজেদের হত্যা করোনা; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল।’ (সুরা নিসা : আয়াত ২৯)
‘তোমরা নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৬)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) নিজেকে ফাঁস লাগাতে থাকবে আর যে ব্যক্তি বর্শার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে (অনুরূপভাবে) বর্শা বিদ্ধ হতে থাকবে।’ (বুখারি)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে; চিরকাল সে জাহান্নামের ভেতরেৎ এভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোক লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনের ভিতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে।
এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আত্মহত্যাকারীর জানাজাও পড়েননি। হাদিসে এসেছে-
হজরত জাবের ইবনে সামুরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক ব্যক্তির লাশ উপস্থিত করা হল। সে চেপ্টা তীরের আঘাতে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জানাজা আদায় করেননি।’ (মুসলিম)
কুরআন সুন্নাহর আলোকে এটি প্রমাণিত যে, আত্মহত্যা মারাত্মক অপরাধ ও হারাম কাজ। আর এর পরিণতিও খুবই ভয়াবহ। আত্মহত্যাকারীকে জাহান্নামের আগুনে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...