রকস্টার থেকে ধর্মপ্রচারক জুনায়েদ জামশেদ
জুনায়েদ জামশেদ খান (৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ – ৭ ডিসেম্বর ২০১৬) ছিলেন একজন পাকিস্তানি গায়ক-গীতিকার, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন ডিজাইনার, অভিনেতা এবং ইসলাম ধর্মপ্রচারক।
প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন পপ-তারকা। তাঁর মিউজিক-ইন্ডাষ্ট্রি Vitalsings -এর গান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। তার অ্যালবাম পাকিস্তানের সঙ্গীত চ্যানেল চার্টে শীর্ষস্থানে। বিমানবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জামশেদের ছেলে জুনায়েদ লাহোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েশন করেন৷ এরপর শখের বশেই রাহেল হায়াত ও শাহজাদ হাসানের সঙ্গে ১৯৮৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশাত্মবোধক গান ‘দিল দিল পাকিস্তান’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দেশটির প্রথম পপ ব্যান্ড ‘ভাইটাল সাইন’৷ তাদের প্রথম হিট এ্যালবাম ‘দিল দিল পাকিস্তান’ এনে দেয় আকাশচুম্বী খ্যাতি। এই গানটিই ঘুরিয়ে দেয় তার জীবনের মোড়। ১৯৯৪ সালে পিটিভির ‘ঢুন্ডলে রাস্তে’ সিরিজটির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে জুনাইদ এবার নাম লেখালেন অভিনেতার খাতায়! অভিনেতা হিসেবে ছোট একটি ইনিংস খেলে জুনাইদ এবার মন দিলেন সলো গানের ক্যারিয়ারে। ১৯৯৮ সালে ব্যান্ড ছেড়ে এসে বের করলেন সলো অ্যালবাম ‘উস রাহ পার’ (১৯৯৯)। এই অ্যালবাম থেকে টাইটেল ট্র্যাকটি সহ ‘না তু আয়েগি’, ‘আঁখোঁ কো আঁখোঁ নে’, ‘ও সানাম’ বাজারে তুমুল জনপ্রিয় হয়। ২০০১ সালে বের হয় তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘দিল কি বাত’। ২০০৩ সালে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক জরিপে ‘সেরা ১০ সুর’-এর তালিকায় ৭,০০০ গানকে পিছে ফেলে জায়গা করে নেয় জুনাইদের ‘দিল পাকিস্তান’।
৯/১১ এর পর নিরাপত্তা আশঙ্কা ও ইসলামবিদ্বেষের কারণে জুনাইদ জামশেদের সব কনসার্ট বাতিল হতে থাকে পাশ্চাত্যে। জনপ্রিয়তার শিখর থেকে হুট করে এমন খাদেই পড়লেন জুনাইদ যে কোর্ট কর্তৃক তিনি দেউলিয়া পর্যন্ত ঘোষিত হলেন ২০০৪ সালে!২০০২-এর পর তার মধ্যে পরিবর্তন আসে এবং মিউজিক-এর প্রতিষ্ঠিত জগৎ ছেড়ে তিনি চলে আসেন ইসলামী ভুবনে। সম্পূর্ণ ইসলামী বেশভূষা অবলম্বন করেন এবং উলামা-সুলাহার সাহচর্য গ্রহণ করেন। হামদ-নাত ও ইসলামী নাশীদের ভুবনেও তিনি ব্যাপক সমাদৃত হন। লাভ করেন কোটি মুসলিমের হৃদয়-নিংড়ানো ভালবাসা। তাঁর দরদী কণ্ঠের ‘মুহাম্মাদ কা রাওযা কারীব আ রাহা হ্যায়’ কত আশেকে রাসূলকে আকুল করেছে! তাঁর কণ্ঠের ‘ইলাহী তেরে চৌখট পর’ কত খোদাপ্রেমিকের অশ্রু ঝরিয়েছে! মৃত্যুর পর অসংখ্য মুসলিমের যে অশ্রুভেজা হৃদয়-ভাঙ্গা দুআ তিনি পেয়েছেন তা তো খুব স্বল্প-সংখ্যক মানুষের ভাগ্যেই জোটে।
২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর পি আই এ ফ্লাইট দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেন এ সময়ের বিখ্যাত ‘না‘তখাঁ’ জুনায়েদ জামশেদ রাহিমাহুল্লাহু তাআলা ওয়াগাফারা লাহু। একটি দ্বীনী দাওয়াতের কাজ শেষে তিনি ঐ বিমানে চিত্রাল থেকে ইসলামাবাদে ফিরছিলেন। বিমানটিতে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন। জাহাজটির ৪৭ যাত্রীর কেউই বেঁচে থাকেনি। সস্ত্রীক নিহত জুনাইদের দেহকে স্বাভাবিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এক্সরে ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল দ্বারা সনাক্ত করতে হয়েছিলো তাকে। তার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান হয়েছিলো তার অগণিত ভক্ত, যারা কেউ ভালোবেসেছিলো রকস্টার জুনাইদকে, কেউবা বেসেছিলো নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম গায়েন জুনাইদকে। এভাবেই ইতি ঘটেছিলো একটি বর্ণবহুল জীবনের, একটি বর্ণাঢ্য গল্পের। পাকিস্তানের কে. কে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তাঁর জানাযায় হয়েছিল লাখো মানুষের সমাবেশ। সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তাগণসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও দাঈগণ। শেষে তার অসীয়ত অনুসারে তাকে দাফন করা হয় পাকিস্তানের বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম করাচির কবরস্থানে।
২০১৮ সালে, জামশেদ দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (মরণোত্তর) এর জন্য মনোনীত হন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন