আমেরিকার বিরোধিতাকারী পাক শাসকদের পরিণতি
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৭৪ বছরে এ পর্যন্ত ২২ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কেউ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন তিনি। এর আড়াই বছরের মাথায় খুন হতে হয় তাঁকে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগে এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। তাৎক্ষণিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের কারণ জানা না গেলেও পরবর্তী সময়ে এর রহস্য উন্মোচিত হয়। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক গোপন নথি থেকে জানা যায়, আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকারের সহায়তায় লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।
গোপন ওই নথির বরাতে জানা যায়, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানে তেল–সংশ্লিষ্ট চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য লিয়াকত আলী খানকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে ইরানের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু লিয়াকত আলী খান যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রস্তাবে রাজি হননি। এমনকি পাকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরানোর দাবি জানান তিনি। যে কারণে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে সিআইএ। কৌশলগত কারণে তারা আফগানিস্তানের শরণাপন্ন হয়। আফগানিস্তানও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর জনসভায় ভাষণ দিতে উঠলে সৈয়দ আকবর নামের এক আততায়ী লিয়াকত আলী খানের বুক বরাবর দুটি গুলি করেন। তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো যায়নি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে। মৃত্যুর পর তাকে শহীদ-এ-মিল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাওয়ালপিন্ডির যে উদ্যানে তিনি নিহত হন, সে উদ্যানের নামকরণ করা হয় “লিয়াকত বাগ”। প্রায় ৫৬ বছর পর একই স্থানে পাকিস্তানের আরেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো আততায়ীর হামলায় নিহত হন।
জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন যিনি, সেই জেনারেল জিয়া-উল-হকের পরিণতিও সুখকর হয়নি। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় আসেন তিনি। দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন জিয়া-উল-হক। ১৯৮৮ সালের ৭ আগস্ট রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৪০০ মাইল দক্ষিণে বাহওয়ালপুর থেকে রাজধানীতে ফিরছিলেন তিনি। পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড রাফেল ও মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম ওয়াসমও তাঁর সঙ্গে একই উড়োজাহাজে ছিলেন। লকহিড মার্টিনের তৈরি সি-১৩০বি বিমানটি উড্ডয়নের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মাটিতে আছড়ে পড়ে ৬০-৭০ ডিগ্রি কোণে বিধ্বস্ত হয়। এতে উড়োজাহাজে থাকা ৩১ জন নিহত হন।
এই দুর্ঘটনা ঘিরে শুরু থেকেই রহস্যের গন্ধ পেয়েছিলেন অনেকে। জিয়াউল হক চেয়েছিলেন সত্যিকারের একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি ছিলেন খুবই অমায়িক ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। পকেটে সব সময় কুরআনের ছোট্ট একটি কপি রাখতেন। এ জন্য তাকে জীবন দিতে হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। বলা হয়, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা। তারা বুঝে গিয়েছিল, জিয়াউল হককে না সরালে পাকিস্তানকে কব্জায় আনা যাবে না। তার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছিল, সে বিষয়ে সতর্কও করা হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে তাকে বহনকারী বিমানটির দুর্ঘটনা এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যেন কেউ সন্দেহ না করে। জিয়াউল হকের পাশাপাশি এই দুর্ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের এক শীর্ষ কূটনীতিবিদ নিহত হন, নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক জেনারেল। তাদের মৃত্যুর পরও যুক্তরাষ্ট্রের যে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল তদন্তে, বাহ্যিকভাবে সেটা কখনোই দেখা যায়নি। কংগ্রেসে অল্প কয়েকটি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়, এক বছর পর্যন্ত এফবিআইকে রাখা হয় তদন্ত প্রক্রিয়ার বাইরে। এই দুর্ঘটনার সাথে সংযুক্ত প্রায় আড়াইশো পৃষ্ঠার কূটনৈতিক ডকুমেন্ট ক্লাসিফাইড সিক্রেট হিসেবে রেখে দেওয়া হয়েছে ন্যাশনাল আর্কাইভে। দুর্ঘটনার পর জিয়াউল হকের লাশের সাথে ওই ছোট্ট কুরআন শরিফটি পাওয়া যায়, প্রায় অক্ষত অবস্থায়।
রাশিয়া-ইউক্রেন উত্তেজনার মধ্যেই গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুদিনের সফরে ইমরান খানের মস্কো যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকে।রাশিয়ায় পৌঁছেই ইমরান খান বলেছিলেন, এক উত্তেজনাময় সময়ে রাশিয়ায় এসেছি। খুব শিহরিত বোধ করছি। ইমরান খান রাশিয়ায় পৌঁছার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। যদিও পাকিস্তান বলছে ওই সফর আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। তবে এর কারণে একটা ভুল বার্তা পৌঁছেছে পশ্চিমের কাছে। তাই সেই সব পশ্চিমার সঙ্গে মিলেই বিরোধীরা তাকে সরানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ তোলেন ইমরান খান। মাসখানেক আগে আমেরিকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে মার্কিন প্রশাসন তাকে জানিয়ে দিয়েছে, যদি ইমরান খানকে নো-কনফিডেন্সের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা না হয় তাহলে পাকিস্তানকে এর মূল্য দিতে হবে। পাকিস্তানি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বে মার্কিন সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠকে ইমরান খানকে হটানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে জানিয়ে দেওয়া হয় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারির মাধ্যমে।সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ওইভাবে সমর্থন করছে না, যেভাবে তারা চার-পাঁচ মাস আগেও করেছিল। কারণ, সেনাবাহিনীর বিশ্বাস যদি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতায় থাকেন তাহলে পাকিস্তানকে আমেরিকা কঠিন সমস্যার মধ্যে ফেলবে, যার পরিণতি ভালো হবে না। এই পরিণতির মধ্যে পশ্চিমা দেশে পাকিস্তানিদের পণ্য রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকিও রয়েছে। এটা সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কিছু সদস্যের ধারণা।শেষ পর্যন্ত বিরোধীরা একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। অনেক নাটকীয়তা শেষে রোববার মধ্যরাতে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন ১৭৪ জন সাংসদ। এই ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার বিষয়টি পাকা হয় ইমরান খানের।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন