লোকসান ওয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে
প্রায় তিন হাজার কিলোমিটারের রেল নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের।যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিদিন ৩৯৪টি ট্রেন পরিচালনা করে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটির।
দেশে ১০৪টি আন্তঃনগর এবং ২৫৪টি মেল, কমিউটার ও লোকালসহ মোট ৩৫৮টি ট্রেনে সিটবিহীন টিকিট বিক্রি হয় ১০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।টিকিট কালোবাজারি কিংবা টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটছে। এসব কাজে রেলওয়েরই কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে টিকিট পরিদর্শকসহ রেলওয়ের রানিং স্টাফদের বিরুদ্ধে বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে টাকা আদায়ের অভিযোগও পুরনো।বাংলাদেশ রেলওয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির একাধিক খাত চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। খাতগুলো হলো সম্পত্তি ইজারা ও হস্তান্তর, অবৈধ স্থাপনা তৈরি, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং ইত্যাদি।রেলে বর্তমানে প্রায় ৭৭ শতাংশ ইঞ্জিন এবং প্রায় ৭০ শতাংশ বগি মেয়াদোর্ত্তীণ-আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ৯ বছরে রেলে আয় হয়েছে ৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। আর পরিচালনা ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। মোট লোকসান হয়েছে ৯ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। অথচ ১০ বছর ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার রেলে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় করেছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যয় করতে হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। আগের দুই অর্থবছরের চিত্রও প্রায় অভিন্ন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা আয় করতে রেল ব্যয় করে ৫ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। তার আগের অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। ৩ বছরে ৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা আয় হলেও ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ১৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে রেলকে।এর বাইরে প্রকল্প ব্যয় তো আছেই। রেলে ৩৯ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো সমাপ্ত হলে রেলের ব্যয়ের অঙ্ক বাড়বে তিনগুণের বেশি। জনগণের করের টাকায় প্রতি বছরই বিপুল অঙ্কের টাকা লোকসান দিয়ে রেলকে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোর মান রয়ে গিয়েছে বৈশ্বিক সূচকের তলানিতে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) তথ্য মতে, এশিয়ায় খারাপ রেল অকাঠামো রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ রেলপথ রয়েছে আর মাত্র তিনটি দেশে। থাইল্যান্ডের অবস্থান সূচকের ৭৫ নম্বরে। জর্ডান ও ফিলিপাইন রয়েছে যথাক্রমে ৮০ ও ৮৬ নম্বরে। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের।
দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে ট্রেন পরিচালনার ব্যয় ও আয়ের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। বাংলাদেশ রেলওয়েকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো যাত্রীসেবা, অনবোর্ড সেবা, ক্যাটারিং সেবার মান বৃদ্ধিসহ যাত্রীদের টিকিটপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, পণ্যবাহী ও কনটেইনার ট্রেন পরিচালনায় গুরুত্ব দেয়া, কমিউটার ট্রেনকে আরো জনবান্ধব করে তোলা এবং বেদখলে থাকা জমি উদ্ধার করে সেগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার করা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন