সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তাজমহলের তালাবদ্ধ ২২ কক্ষের রহস্য কী?

 





ভারতে অনেকদিন ধরে একটি কল্পকথা চলে আসছে যে তাজমহল আসলে একটি হিন্দু মন্দির ছিল। দেবতা শিবের নামে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল।পি এন ওক - যিনি ১৯৬৪ সালে ভারতের ইতিহাস নতুন করে রচনার জন্য একটি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন - তার এই বইতে লিখেছেন, তাজমহল সন্দেহাতীতভাবেই একটি শিব মন্দির ছিল।২০১৭ সালে বিজেপির এক নেতা সাংগিত সোম বলেন তাজমহল ভারতের ইতিহাসের "একটি কলঙ্ক" কারণ, তার মতে, "বিশ্বাসঘাতকরা ছিল এর নির্মাতা।" এ সপ্তাহেই বিজেপির একজন এমপি দিয়া কুমারি বলেন, শাহজাহান হিন্দু একটি রাজপরিবারের জমি দখল করে তাজমহল বানিয়েছিলেন।তাজমহল ‘তেজো মহালয়’ নামে শিব মন্দির বলে দাবি হিন্দুত্ববাদীদের।
তাজমহলের তালাবন্ধ ঘরগুলোতে আসলে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে রয়েছে?ভারতের একটি হাইকোর্টের বিচারকরা তা মনে করেননি। সে কারণেই তারা ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপির একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতার আনা একটি অবেদন খারিজ করে দিয়েছেন।রাজেশ সিং তার আবেদনে দাবি করেছিলেন তাজমহলের ২০টিরও বেশি "স্থায়ীভাবে তালাবন্ধ" কক্ষগুলো খুলে দেওয়া হোক যাতে "এই সৌধের প্রকৃত ইতিহাস" বেরিয়ে আসে।মি. সিং খুব আদালতকে বলেন, তিনি দেখতে চান তাজমহলের ভেতরের তালা দেওয়া ঘরগুলোতে হিন্দু দেবতা শিবের একটি মন্দির রয়েছে বলে যে "দাবি ঐতিহাসিকরা এবং ভক্তরা করেন" - তা যথার্থ কিনা।তালা দেওয়া যে কক্ষগুলোর কথা মি. সিং তুলছেন সেগুলোর অধিকাংশই সৌধের ভূগর্ভস্থ অংশে অবস্থিত। এবং তাজমহলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন এমন অনেক মানুষের মতে, ভূগর্ভস্থ ঐ ঘরগুলোর ভেতর আদৌ কোনো রহস্য নেই।
এদিকে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্থা আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই) সেই গোপন কুঠুরিগুলির ছবি প্রকাশ করেছে।
এএসআই জানিয়েছে ওই কুঠুরিগুলোয় কোনও গোপনীয়তা নেই। এগুলো মূল কাঠামোর অংশ। শুধু তাজমহল নয়, এমন কুঠুরি অনেক স্থাপত্যেই রয়েছে। উদারহণ হিসেবে দিল্লিতে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধির কথাও বলা হয়েছে।তাজমহল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা এএসআইয়ের ‘ আগ্রা সেল’ জানিয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যমুনা নদী লাগোয়া ভূগর্ভস্থ ঘরগুলিতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়েছিল। সে সময়ই ছবিগুলো তোলা। প্রকাশিত চারটি ছবি ডিসেম্বরে তোলা হয়েছিল।
মোগল স্থাপত্যের একজন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ এবা কোচ, যিনি তাজমহলের ওপর গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন, তার গবেষণার সময় ঐ সমস্ত কক্ষ এবং ভেতরের সমস্ত প্যাসেজ বা পথের ভেতর ঢুকে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং ছবি তুলেছেন।তিনি লিখেছেন, তাজমহলের নিচে ভূগর্ভস্থ ঐ কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল 'তাহখানা'র অংশ হিসাবে। মোগলরা গরমের মাসগুলোতে শরীর শীতল রাখতে এমন ভূগর্ভস্থ কক্ষ তৈরি করতো।
সৌধের নিচে নদীমুখী একটি চত্বরে সারিবদ্ধ বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। মিজ কোচ নদীর সমান্তরাল এরকম ১৫টি কক্ষের কথা লিখেছেন। সরু একটি করিডোর দিয়ে ঐ চত্বরে যাওয়া যায়।এগুলোর মধ্যে সাতটি কক্ষ বেশ বড় - যেগুলোর প্রতিটির দুই দেয়ালে বর্ধিত অংশ রয়েছে। ছয়টি কক্ষ চার দেয়ালের এবং দুটি কক্ষে দেয়ালের সংখ্যা আটটি করে।বড় আকৃতির কক্ষগুলোর সামনে রয়েছে কারুকার্য খচিত খিলান বা তোরণ - যেগুলোর ভেতর দিয়ে যমুনা দেখা যায়।ঘরগুলোর সাদা চুনকাম করা দেয়ালের নিচে মিজ কোচ "রঙিন কারুকার্যের" নমুনা দেখেছেন।
"এটা নিশ্চিত যে সম্রাট যখন এই সৌধে আসতেন তখন এসব প্রশস্ত, সুন্দর এবং শীতল কক্ষগুলো ছিল তার, সহযোগীদের এবং তার নারীদের আদর্শ বিশ্রামের জায়গা," লিখেছেন মিজ কোচ যিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান আর্টস বিভাগের একজন অধ্যাপক।এধরণের ভূগর্ভস্থ গ্যালারি মোগল স্থাপত্যের অংশ ছিল। পাকিস্তানের লাহোরে মোগলদের একটি দুর্গে জলাধারের সমান্তরাল এমন সার দেওয়া ভূগর্ভস্থ কক্ষ রয়েছে।সম্রাট শাহজাহান অনেকসময় যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলের আসতেন। অনেক সিঁড়িবাধা একটি ঘাটে নেমে তাজমহলে ঢুকতেন তিনি।
ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক অমিতা বেগ যিনি ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে ঢুকেছিলেন। তিনি পরে লেখেন, "সেখানে গিয়ে চমৎকার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডোর দেখেছিলাম। ঐ করিডোর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়। পরিষ্কার বোঝা যায় সম্রাট এই করিডোর দিয়ে ঢুকতেন"।দিল্লিতে ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি, যিনি আগ্রায় বড় হয়েছেন - বলেন ১৯৭৮ সালে এক বন্যার আগ পর্যন্ত তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ঐ অংশে পর্যটকরা যেতে পারতেন।"বন্যার পানি তাজমহলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল, পানি নামার পর মাটির নিচের ঐ ঘরগুলোর মেঝেতে পলির আস্তরণ পড়েছিল। দেয়ালে, মেঝেতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। তারপরই কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের জন্য ঘরগুলোতে ঢোকা বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতর কিছুই নেই।, " বলেন মিজ সাফাভি।শুধু মাঝেমধ্যে সংস্কার কাজের জন্য ঘরগুলো খোলা হয়।
ঐতিহাসিক মিজ সাফাভি বলেন গত এক দশকে তাজমহল নিয়ে কল্পকথা আর গুজবের তত্ত্ব নতুন করে কট্টর হিন্দুদের একটি অংশের মধ্যে প্রাণ পেয়েছে। "কট্টরপন্থী এই অংশটি ভুয়া খবর, ভুয়া ইতিহাস এবং হিন্দুদের ওপর কল্পিত নিপীড়ন অবিচারের তত্ত্বে মশগুল।"মিজ কোচও লিখেছেন,"তাজমহলকে নিয়ে যতটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে কল্পকথার চর্চা ।
সূত্র - ইন্টারনেট অবলম্বনে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...