আতর কিভাবে এলো ?
আতর শব্দটি পারসিয়ান শব্দ ইতির থেকে এসেছে, যার অর্থ সুগন্ধি। লাতিন শব্দমূল 'পার' ও 'ফিউম' (ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে) থেকে আমাদের কাছে পারফিউম বা সুগন্ধির আত্মপ্রকাশ। উদ্ভিদ বা ফুলপাতাকে পেষণ করে সরাসরি পানি বা তেলের মধ্যে দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রথম এই সুগন্ধি তৈরি করে।
সুগন্ধির প্রতি অনুরাগ নবী-রাসুলদের আদর্শ। সুগন্ধি ও সুরভির ব্যবহার রাসুল (সা.)-এর সুন্নতও বটে। বিভিন্ন উপলক্ষে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সুগন্ধি-আতর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আতর-সুরভিকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করা হয়। লোকসমাগমে, জুমার দিন ও ঈদের দিনে সুগন্ধি ব্যবহারের বিশেষ তাগিদ রয়েছে। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জুমার দিন তোমরা যথাসম্ভব সুগন্ধি ব্যবহার করো।’ (নাসায়ি শরিফ, হাদিস : ১৩৫৮) পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে সুগন্ধি ব্যবহারের রীতি দেখা যায়। এই হিসাবে বলা যায়, ধর্মের ইতিহাসের মতো সুগন্ধির ইতিহাসও অত্যন্ত প্রাচীন। পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থগুলোর বর্ণনায় সুগন্ধি ব্যবহারের কথা জানা যায়।
আতরের উৎপত্তিস্থল হিসেবে মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক, কুয়েত ও সৌদি আরব) নামই পাওয়া যায় বেশি। সাইপ্রাসে চার হাজার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত সুগন্ধির কারখানার সন্ধানও পাওয়া গেছে। বিশ্বের প্রথম নারী রসায়নবিদ তাপ্পুতির কথা রয়েছে সুগন্ধির বিভিন্ন ইতিহাসে।প্রাচীনকালে মিশরীয়রা সুগন্ধী তৈরীতে প্রসিদ্ধ ছিল। বিভিন্ন গাছপালা এবং ফুল থেকে নির্য়াস সংগ্রহ করে বিভিন্ন তেলের সাথে মিশিয়ে আতর তৈরি করা হত। রোমান ও পারসিয়ানরা সুগন্ধি বানানোর প্রক্রিয়া আরো আধুনিক করে তোলে।
পরবর্তীতে বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক আল শেখ আল-রইস নানারকম সুগন্ধি তৈরীর প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবন করেন। পাতন পদ্ধতির সাহায্যে সুগন্ধি তৈরীতে তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ । বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, তিউনিশিয়া, লেবানন, মিসর, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, চেক রিপাবলিক, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ সর্বাধিক সুগন্ধি উৎপাদন করে।আরব বণিক ও পর্যটকদের ভ্রমণকাহিনিতেও এ অঞ্চলের সুগন্ধির প্রশংসা পাওয়া যায়। তাদের বর্ণনা থেকে ধারণা হয়, মধ্যযুগে ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ সুগন্ধি কাঠ, মসলাসহ সুগন্ধির অন্যান্য উপকরণ তৈরি হতো।
আগর-আতর একটি প্রাকৃতিক সুগন্ধি পণ্য। এ আগর-আতর শিল্প বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকারের এক জেলা এক পণ্য হিসেবে মৌলভীবাজার জেলায় একে বেছে নেয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে প্রায় ২০০টির মতো ছোট-বড় কারখানা। এখানকার উৎপাদিত আগর-আতর শতভাগ বিদেশে রপ্তানি হয় এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়।সিলেট বিভাগের পাহাড়ে এখনো আতরের চাষ হয়। স্থানীয়রা ওইসব পাহাড়কে আতর পাহাড় বলে ডাকেন। আতর পাহাড়ে সারি সারি আগর গাছ। বয়স্ক গাছে দা দিয়ে কুপিয়ে রেখে দিলে সেখান থেকে রক্তের মতো ঘনরস পড়ে। গাছের সেই রস থেকেই পরে তৈরি হয় আতর।
বাংলাদেশের সুগন্ধি ব্র্যান্ড আল হারামাইনসহ বিভিন্ন কম্পানি সুগন্ধি তৈরি করে প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে আকাশছোঁয়া সাফল্য পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে বেশ সুনামের সঙ্গে অভিজাত ব্র্যান্ডের সুগন্ধি ও প্রসাধনসামগ্রী বাজারজাত করছে, যা সেখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও উচ্চ শ্রেণির ক্রেতাদের শৌখিন জীবনযাপনের অত্যাবশ্যকীয় প্রসাধনীতে পরিণত হয়েছে।বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৬৫টি দেশে সুগন্ধি রপ্তানি হচ্ছে।
ফুলের নির্যাস, মৃগনাভি ইত্যাদির সুরভিত তেল দিয়ে আতর-সুগন্ধি তৈরি করা হয়। মেশক, আম্বারও উত্তম সুগন্ধি। মহানবী (সা.) মেশক খুব পছন্দ করতেন। হরিণের নাভি থেকে এটা তৈরি করা হয়। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম সুগন্ধি হলো মেশক।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৯১২)মেশক, চন্দন ও জাফরানের সুগন্ধি রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবহার করেছেন। বোঝা যায়, মহানবী (সা.) বৈচিত্র্যময় সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।উপহার হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) সুগন্ধি পছন্দ করতেন এবং সুগন্ধি বিনিময়কে উৎসাহিত করতেন। যেমন—হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.)-কে কেউ সুগন্ধি উপহার দিলে তিনি গ্রহণ করতেন; ফিরিয়ে দিতেন না। কেউ সুগন্ধি দিলে ফিরিয়ে দিতেও তিনি নিষেধ করেছেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৫৮৫। আনাস (রা.)-এর অন্য বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীর সুগন্ধি আমার কাছে প্রিয় করা হয়েছে এবং নামাজের ভেতর আমার চোখের শীতলতা রাখা হয়েছে।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩৯৩৯)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন