মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে এলার্জি অথচ এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা থেকে ভারতের সবচেয়ে বেশি আয়




সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের আগমন ঘটে। যা গৌরবোজ্জ্বল মোগল শাসনের অবসানের আগ পর্যন্ত তথা ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়িত্ব লাভ করেছিল।মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষ পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায় মুসলিম শিল্প সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের সাথে। বর্তমানে ভারতে কয়েক হাজার মুসলিম স্থাপনা রয়েছে। যেসব স্থাপত্য ভারতের পর্যটন খাতের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস।
বর্তমানে ভারতে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন শহর, জেলা, জনপদ, রাস্তার নাম বদলের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ইসলামি নামের সঙ্গে যা কিছু যুক্ত, ‘ভারতীয়করণ’–এর নামে তার ‘হিন্দুত্বকরণ’ হচ্ছে। এলাহাবাদের নাম বদলে করা হয়েছে প্রয়াগরাজ।ফৈজাবাদ জেলার নাম বদলে করা হয়েছে অযোধ্যা। প্রবল দাবি উঠেছে মুজাফফরনগরের নাম বদলে ‘লক্ষ্মীনগর’, আহমেদাবাদের নাম বদলে ‘কর্ণাবতী’, আগ্রার নাম পাল্টে ‘অগ্রবন’ করার। দুই দিন আগে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন কুতুব মিনারের নাম বদলে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ করার দাবি তোলে।তবে বিজেপি থেমে নেই। দিন তিনেক আগে দিল্লি বিজেপির সভাপতি আদেশ গুপ্ত রাজধানীর ছয়টি রাস্তার নাম বদলের দাবি দিল্লি সরকার ও নতুন দিল্লি পৌরসভার কাছে পেশ করেন। তাঁর দাবি, শাহজাহান রোড হোক ‘জেনারেল বিপিন রাওয়াত রোড’, হুমায়ুন রোড ‘মহর্ষি বাল্মীকি রোড’, আওরঙ্গজেব লেন ‘ড. এপিজে আবদুল কালাম লেন’, তুঘলক রোডের নাম হোক ‘গুরু গোবিন্দ সিং রোড’, আকবর রোডের নতুন নাম হোক ‘মহারাণা প্রতাপ রোড’ এবং বাবর লেনের নামকরণ হোক ‘বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বোস লেন’। শুধু রাস্তাই নয়, বিজেপি চায় দিল্লির মধ্যে অন্তত ৪০টি অঞ্চলের নাম স্বাধীনতাসংগ্রামী, দেশপ্রেমিক, খেলোয়াড়, শিল্পীদের মতো গুণী মানুষের নামে রাখতে। ওই ৪০টি অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ইউসুফ সরাই, হুমায়ুনপুর, বেগমপুরা, হাউজ খাস, আজাদপুর, সাইদুল আজবের মতো পরিচিত এলাকা।
প্রিয়তমা মমতাজের স্মৃতি রক্ষার্থে সম্রাট শাহজাহান ১৬৩১ সালে যে কাজে হাত দিয়েছিলেন, ২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিকের উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে তা শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। সেই বিস্ময়-স্থাপত্য তাজমহলকে ঘিরে বিতর্ক মাঝেমধ্যেই তা মাথাচাড়া দেয়। ২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশের একদল আইনজীবীও এ নিয়ে মামলা করেছিলেন। তাঁদেরও দাবি ছিল, তাজমহল আসলে এক শিবমন্দির।২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের কট্টরবাদী বিজেপি নেতা বিনয় কাটিয়ার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন তাজমহলের অভ্যন্তরে কোনো হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে। ২০১৯ সালে কর্ণাটকের বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে দাবি করেন, শাহজাহান নাকি আদৌ তাজমহল তৈরি করেননি। ওটা তিনি কিনেছিলেন রাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে।আজ যার পরিচয় তাজমহল, তা আসলে ‘তেজো মহালয়’ নামে এক প্রাচীন শিবমন্দির, যার ওপরে নির্মিত হয়েছে তাজমহল এই দাবিতে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়।
ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে পুরাতত্ত্ববিদেরা কেউই কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে সহমত হননি তাজমহল নিয়ে গত বুধবার আসর সরগরম করেন রাজস্থানের জয়পুর রাজপরিবারের রানি দীয়া কুমারীও। বিজেপির লোকসভা সদস্য জয়পুরের শেষ মহারাজা মান সিংয়ের এই নাতনির দাবি, যে জমিতে তাজমহল তৈরি, একসময় তা ছিল জয়পুর রাজপরিবারের।
ভারতের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এই পাঁচটি প্রাচীন নিদর্শন থেকে ভারত সরকারের আয় হয়েছে ১৪৬.০৫ কোটি রুপি, যা ভারতের রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষিত প্রাচীন নিদর্শনাবলীর মোট আয়ের (২৭১.৮ কোটি) অর্ধেকের চেয়েও বেশি।শুধু তাজমহল থেকেই আয় হয় ৫৬.৮৩ কোটি রুপি। বছরটিতে ৬৪.৫৮ লাখ দেশী-বিদেশী দর্শনার্থী এ স্থাপনাটি ঘুরে দেখেন।২০১৪-১৫ সালে যেখানে ২১.২ কোটি টাকা আয় করেছিল তাজমহল সেখানে ২০১৮-১৯ সালে আয় বেড়ে হয়েছে ৮৬.৫ কোটি টাকা ৷আগ্রা ফোর্ট থেকে ১০ কোটি ২২ লাখ রুপি। কুতুব মিনারের আয় ১০ কোটি ১৬ লাখ রুপি। হুমায়ুনের সমাধি থেকে আয় ৭ কোটি ১২ লাখ রুপি। রেড ফোর্টের আয় ৬ কোটি ১৫ লাখ রুপি।ফতেহপুর সিক্রি দুর্গ আয় করে ৫ কোটি ৬২ লাখ রুপি। এ দুর্গ দেখতে দেশি দর্শনার্থীদের ৩০ রুপি পরিশোধ করতে হয় আর বিদেশিদের পরিশোধ করতে হয় ৫০০ রুপি ১৫৭১-১৫৮৫ পর্যন্ত মোঘল সম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ফতেহপুর সিকরি। ১৫৭৩ সালে এ দুর্গটির নাম হয় ফতেহপুর সিকরি।গোলকুন্ডা দুর্গ থেকে ভারত আয় করে ৯২ লাখ রুপি।এতো আয়ের পরও ভারতের অনেক রাজনীতিকদের মাঝে চলে ব্যাপক বিতর্ক। তাদের ভাষায় মুসলিম শাসকদের আমলে নির্মিত এসব স্থাপনা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন । যে কারণে ইউপি ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট তাদের প্রধান পর্যটনকেন্দ্রের তালিকা থেকে তাজমহলকে বাদ দেয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল