মক্কা ও মদিনায় কেন অমুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ



"হে ঈমানদারগন! মুশরিকরা তো অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদুল -হারামের নিকট না আসে.....( সুরা তওবা আয়াত -২৮)

কোন কোন মুফাসসির বলেন, কাফেরগণ ব্যহ্যিক ও আত্মিক সর্ব দিক থেকেই অপবিত্র। (কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর) তবে অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ এখানে নাপাক বলতে তাদের দেহ সত্তা বুঝানো হয়নি, বরং দ্বীনী বিষয়াদিতে তাদের অপবিত্রতা বোঝানো হয়েছে। সে হিসেবে এর অর্থ, তাদের আকীদাহ-বিশ্বাস, আখলাক-চরিত্র, আমল ও কাজ, তাদের জীবন — এসবই নাপাক। (ইবন কাসীর; সা’দী) আর এ সবের নাপাকির কারণেই হারাম শরীফের চৌহদ্দির মধ্যে তাদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।পবিত্র মক্কা নগরী রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্মস্থান।এখানে ইসলামের অনেক পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ন নিদর্শনাবলী রয়েছে।এখানে রয়েছে পবিত্র কাবা ঘর যা মুসলমানদের কিবলা(যে দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা হয়)।ইসলাম ধর্ম মতে কাবাকে সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করা হয়।কাবাকে ঘিরে রয়েছে মসজিদুল হারাম। কাবাঘরের চারপাশের প্রায় ২ বর্গমাইল এলাকা হারাম হিসেবে সাব্যস্ত। পরবর্তীতে শাসকরা সতর্কতা হিসেবে তার ব্যাপ্তি বাড়িয়ে মক্কা গেইট পর্যন্ত নিয়ে যান।
উপরিউক্ত আয়াতের প্রথম অংশে বলা হয়েছে, 'এ বছরের পর মুশরিকরা যেন মসজিদুল হারামের কাছেও না আসে।' এ বছর বলতে অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে ৯ম হিজরী বুঝানো হয়েছে। কাতাদা বলেন, এটা ছিল সে বছর যে বছর আবু বকর (রা) লোকদের নিয়ে হজ করেছেন। তখন আলী (রা) এ বিষয়টির ঘোষণা লোকদের মধ্যে দিয়েছিলেন। তখন হিজরতের পর নবম বছর পার হচ্ছিল। আর রাসূলুল্লাহ (সা) পরবর্তী বছর হজ করেছিলেন। তিনি এর আগেও হজ করেন নি, পরেও করেন নি। (তাবারী) উমার বিন আব্দুল আযীয (রঃ) আলোচ্য আয়াতের ভিত্তিতে নিজ রাজত্বকালে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদেরকেও মুসলিমদের মসজিদে প্রবেশ না করার আদেশ জারী করেছিলেন। (ইবনে কাসীর)
এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে আদৌ অমুসলিমরা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে পারবে কি না? এর উত্তর হলো, হানাফি মাজহাব মতে, এ আয়াতে আক্ষরিক অর্থে মসজিদুল হারামে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি; বরং তাদের ওই বছর তথা নবম হিজরির পর থেকে হজ পালনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং অমুসলিমদের মসজিদুল হারামে প্রবেশে কোনো বাধা নেই।
ইমাম শাফেয়ি (রহ)-এর মতে, অমুসলিমরা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে পারবে না, তবে অন্য যেকোনো মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে। ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মতে, অমুসলিমরা হেরেম শরিফে প্রবেশ করতে পারবে না, তবে অন্য যেকোনো মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে।ইমাম মালেক (রহ)-এর মতে, অমুসলিমদের মসজিদুল হারামসহ কোনো মসজিদেই প্রবেশ করা বৈধ নয়। কেননা কাবা শরিফ ও মসজিদুল হারামকে কেন্দ্র করেই অন্য সব মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিদায়া গ্রন্থকার লিখেছেন, 'আহলে জিম্মি বা ইসলামী রাষ্ট্রের আইনকানুন মেনে সেখানে অবস্থানকারী অমুসলিমরা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলে কোনো অসুবিধা নেই।' (হিদায়া : কিতাবুল কারাহিয়্যা) হানাফি মাজহাব ছাড়া অন্য মাজহাব মতে, অমুসলিমরা কিছুতেই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করতে পারবে না। (নেহায়াতুল মুহতাজ : ৮/৮৬; দুররে মুখতার : ৩/২৭৫)
আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) নিজে মদিনা শরীফকেও হারাম হিসেবে সাব্যস্ত করেন। যার ফলে মদিনার মধ্যেও চারদিক থেকে নির্দিষ্ট একটি জায়গার পরে অমুসলিমদের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ।উহুদ পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে দাজ্জাল মদিনার মসজিদের দিকে লক্ষ্য করে বলবে ঐ যে মুহাম্মাদের প্রসাদ, এর পরে সে পা দিয়ে তিন বার আঘাত করবে যার ফলে মদিনায় ভূমিকম্প হবে এবং অমুসলিম ও দুর্বল ঈমানদার যারা আছে তারা মদিনা থেকে বের হয়ে গিয়ে কানা দাজ্জালের দলে যোগ দিবে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ঐ দিনটিকে মুক্তির দিন বলেছেন, কারন ঐদিন অমুসলিম যারা লুকিয়েছিল মদিনায় বিভিন্ন খারাপ উদ্দেশ্য তারা বের হয়ে যাবে।যখন কানা দাজ্জাল বাহির হবে তখন সে সারা পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারবে ২ টি পবিত্র জায়গা ছাড়া তা হল মক্কা আর মদিনা। এই দুই জায়গা আল্লাহ ফেরেশতা দিয়ে পাহারা বসাবেন এই জন্য সে ঢুকতে পারবে না।শুধু মক্কা ও মদিনা কেন? পৃথিবীর অনেক দেশেই তাদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় জায়গায় অন্য ধর্মের লোকের প্রবেশ নিষিদ্ধ যেমন — ভ্যাটিকান, হিন্দুদের কিছু জায়গা আছে যেখানে অন্য ধর্মের লোক প্রবেশ করতে পারে না।
জাকির নায়েক এক বোনের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বোন আপনি কি জানেন, ইন্ডিয়ায় বসবাস বা ইন্ডিয়ায় জন্ম নিয়েও আপনি ইন্ডিয়ার এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না?
মেয়েটির উত্তর, না, এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে না। আমি ইন্ডিয়ার সব জায়গায় প্রবেশ করতে পারি।
ডা. জাকির নায়েক ফের বলেন, আপনি সব জায়গায় প্রবেশ করতে পারলেও একটা জায়গায় প্রবেশ করতে পারবেন না। আর সেটা হলো ক্যান্টনমেন্ট। এখানে তাদেরই প্রবেশ করতে দেয়া হয়, যারা দেশের যেকোনো কল্যাণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
বোন ইসলামের একটা ক্যান্টনমেন্ট আছে, সেটা হলো মক্কা ও মদিনা শরিফ। এখানে তারাই প্রবেশ করতে পারে, যারা আল্লাহর জন্য জানমাল দিতে পারে। আপনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’- এই ক্লাবের পাসপোর্টধারী হলেই আপনি মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করতে পারবেন।ডা. জাকির নায়েকের এমন চমৎকার উত্তর শুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে যান। প্রশ্নকারী হিন্দু মেয়েটি মাথা নিচু করে নিজ আসনে বসে যান।
যে কেউ মক্কায় প্রবেশ করতে পারতো, এমন কোনো সময় কি আদৌ ছিল? অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে মক্কা ছিল ১২২৯ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত। ১৫৬৪ সালের এক লেখা থেকে জানা যায়, এই পুরো সময়টিতে একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী নয়- এমন কেউই মক্কায় প্রবেশ করতে পারতেন না। অটোমান সাম্রাজ্যের ওই ‘ফরমান’, অর্থাৎ জারিকৃত বিধিনিষেধপত্রে বলা ছিল- ‘একের অধিক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী কেউই ইচ্ছা করলেও মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না এবং গৌরবান্বিত কাবা শরীফের আশপাশেও যেতে পারবে না।
জেদ্দা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে গেটের কাছে লেখা ‘নো এনট্রান্স ফর নন–মুসলিম’। মক্কায় অমুসলিমরা প্রবেশ করতে পারে না। সব সময় পুলিশ থাকেন।
সৌদি আরবের সাধারণ আইনে অমুসলিমদের মক্কা নগরীতে প্রবেশাধিকার নেই।জালিয়াতির মাধ্যমে প্রবেশের চেষ্টা করলে গ্রেফতার এবং শাস্তি হতে পারে।আহমাদিয়াদেরও প্রবেশাধিকার নেই কারণ সাধারণ মুসলমানেরা তাদেরকে অমুসলমান হিসেবে বিবেচনা করে।যদিও অনেক অমুসলিম এবং আহমাদিয়া শহরটি ভ্রমণ করেছেন। নিবন্ধিত তথ্যানুসারে প্রথম অমুসলিম হচ্ছে লুডোভিকো ডি ভার্থেমা, তিনি ১৫০৩ সালে মক্কা ভ্রমণ করেন।১৫১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক সাহিব মক্কা ভ্রমণ করেন।বিখ্যাতদের একজন হচ্ছেন রিচার্ড ফ্রান্সি বুর্টন, যিনি আফগানিস্তান থেকে কাদিরিয়া সুফির ছদ্মবেশে ১৮৫৩ সালে মক্কা ভ্রমণ করেন। ভাষাবিদ্যায় দক্ষতা, মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যায় পারদর্শিতা, ভূগোলবিদ্যায় অসামান্য দখলের কারণে তাকে ‘সকল কাজের কাজি’ সম্বোধন করা হয়। তিনি লেখালেখিও করতেন।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় পঁচিশটির ওপরে ভাষা জানা ছিল তার।
আঞ্চলিক ভাষাসহ যার সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশের মতো। তবে তিনি একটি সম্প্রদায়ের কাছে আরও ভালোভাবে পরিচিত তার মক্কা ভ্রমণের কাহিনীর কারণে। তিনি আফ্রিকা ভ্রমণের আগে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে মক্কায় হজ পালন করেন। ২০০২ সালে ইতালীয় রাষ্ট্রদূতও মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন ছদ্মবেশে। সৌদি সরকার আল কোরআনে বর্ণিত উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা তাদের নিজেদের অবস্থান সমর্থন করে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল