সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কাবা শরিফের ইমাম

 





মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক পবিত্র কাবা শরিফ। কাবা ঘরকে ঘিরে অবস্থিত মসজিদে হারাম। প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ের বাসনা থাকে স্বচক্ষে পবিত্র কাবা দেখার। মসজিদুল হারামে নামাজ আদায় করার।
আর সেই কাবা চত্বরে পবিত্র কাবাকে সামনে রেখে ৩৯ বছর ধরে ইমামতির দায়িত্বে হারামাইন প্রেসিডেন্সির প্রধান শায়খ ড. আবদুর রহমান বিন আবদুল আজিজ আস সুদাইস।৪ এপ্রিল কাবার ইমাম হিসেবে দীর্ঘ ৩৯ বছর পার করেছেন এই ইসলামি ব্যক্তিত্ব।
১৪০৪ হিজরির ২২ শাবান (১৯৮৪) শায়খ সুদাইসের সঙ্গে একই দিন শায়েখ সালেহ আল হুমাইদকে মসজিদে হারামের ইমাম ও খতিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ এর রাজকীয় আদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ২২ বছর বয়সী সুদর্শন ও সুকণ্ঠী আলেম আবদুর রহমান আস-সুদাইস। আসরের নামাজের ইমামতির মধ্য দিয়ে তিনি কাবা প্রাঙ্গণে ইমামতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনিই আজকের বিশ্বখ্যাত কারি শায়খ আবদুর রহমান আস সুদাইস। শুধু ইমাম-খতিব হিসেবে নয়, এখন তিনি মক্কা-মদিনার পরিচালনা কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট।২০১২ সালে উভয় পবিত্র মসজিদের প্রেসিডেন্সির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করায় মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়।২০১৪ সালে মসজিদে নববীতে প্রথমবারের মতো ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন।
২০২০ সালে তাকে পুনঃনিয়োগ এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।২০২০ সালে শায়খ সুদাইস মসজিদুল হারামে একাধারে ৩০ বছর যাবত রমজানে পবিত্র কোরআন খতম করেন।
পৃথিবীর আনাচে-কানাচের মুসলমান শায়খ সুদাইসকে চেনেন। তার সুমধুর কণ্ঠের কোরআন তেলাওয়াত শুনতে মানুষ সদা উদগ্রীব। বিনয়ী এই মানুষটি মানবঘনিষ্ঠ। সবসময় সাধারণ মানুষদের কাছে থাকতে ভালোবাসেন। প্রভূত সম্মান ও মর্যাদা তাকে আরও বিনয়ী করেছে। কাবার প্রধান ইমাম হয়েও তিনি ক্লিনারদের সঙ্গে বসে ইফতার করেন। সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করেন। অসুস্থ হাজিদের হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাওয়াফ করান। মসজিদুল হারামের পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নেন।
শায়খ সুদাইসের জন্ম ১৯৬০ সালে সৌদির রাজধানী রিয়াদে। নাম আব্দুর রহমান বিন আব্দুল আযীয আস-সুদাইস। তাঁর পূর্ণ নাম আবু আব্দুল আযীয আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল আযীয ইবন মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ। তবে তিনি আব্দুর রহমান আস-সুদাইস নামেই পরিচিত।তিনি কাছীম রাজ্যের বুকাইরিয়া অঞ্চলের অধিবাসী। তিনি আনাজ কালন আরব উপজাতি সম্প্রদায়ের অর্ন্তভুক্ত। তার স্ত্রীর নাম ফাহদা আলী রউফ। তার চার ছেলে আব্দুল আযীয, বকর, শুয়া‘ইব, আব্দুল্লাহ এবং পাঁচ মেয়ে সুমাইয়া, যাইনব, উমায়মা, নাসিবাহ ও মালিকাহ।
মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনে কারিমের হাফেজ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
আল সুদাইস ১৯৭৯ সালে এবং ১৯৮৩ সালে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন, যেখানে তিনি প্রথম ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মাস্টার্স শেষ করেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সৌদ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ১৯৯৫ সালে তিনি ইসলামী শরীয়াতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যখন তিনি ওখানে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজে নিয়ত ছিলেন।তাঁর প্রথম চাকরি ছিল রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক এবং তারপর উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়।শায়খ সুদাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক ও বিদগ্ধ লেখকও বটে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৯টি। ১৯৯৫ সালে মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ ফ্যাকাল্টি থেকে তিনি পিএইচডি করেন।উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদ-দিরাসাতু ঊলইয়া আশ-শারঈয়াহ বিভাগের প্রধান ড. আলী ইবন আববাস হুকমীর তত্ববধানে ‘আল-ওয়াযেহ ফী উছূলুল ফিকহ লি আবীল অফা ইবন ‘আক্বীল হাম্বলী : দিরাসাত ওয়া তাহক্বীক্ব’ শিরোনামে গবেষণাকর্মটি সম্পন্ন করে মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
দরাজ কণ্ঠে হৃদয়গ্রাহী কোরআন তেলাওয়াতের কারণে সারা বিশ্বে তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। তার প্রেসিডেন্সির মেয়াদকালে মসজিদে হারামের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। যুগোপযোগী নানা প্রকল্প বাস্তবায়নে তার কর্মপরিকল্পনার জুড়ি নেই। মসজিদে হারামের শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে নানা কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজনে রুচিশীলতা ও বৈচিত্র্যও চোখে পড়ার মতো। হারামের পাঠদান কর্মসূচিকে বেগবান রাখতে যোগ্য ও প্রাজ্ঞ আলেম এবং শিক্ষকদের নিয়োগ দেন। হাজিদের শতভাগ সেবা নিশ্চিতে নানা ভাষায় অভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হজের খুতবা দেন শায়খ সুদাইস। মুসলিম জাতির ঐক্যের প্রতীক শায়খ সুদাইস কথিত ইসলামফোবিয়া ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে ইসলামবিরোধীদের কাছে ‘বোমা হামলা এবং সন্ত্রাসবাদ’ বিষয়ে ভুল ধারণার অপনোদন করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০২ সালের ১৯শে এপ্রিল মাসে তিনি তাঁর বক্তৃতায় ইহুদীদেরকে বানর এবং শূকর নামে আখ্যায়িত করেন যা সঊদী গণমাধ্যম প্রচার করেছিল। তিনি তাঁর বক্তৃতায় আরো বলেন, আপনারা ইতিহাস পড়ুন, দেখবেন ইহুদীদের পূর্বসুরীরা ছিল অত্যন্ত খারাপ এবং আজকের ইহুদী সমাজ পূর্ববর্তীদের তুলনায় আরো খারাপ। তারা হ’ল মা‘ছূম-নিষ্পাপ নবীদের হত্যাকারী এবং মূলতঃ তারা দুনিয়ার আর্বজনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা আল্লাহর নিকট অভিশপ্ত, ঘৃণ্য এবং যুলুমবাজ। ফলে আল্লাহ তাদের অবাধ্যতার ফলে শূকর ও বানরে পরিণত করেছিলেন। ইহুদীরা বংশ পরম্পরায় নীচ, ধূর্ত, অবাধ্য, নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট এবং দুর্নীতি পরায়ন। হে আল্লাহ! তুমি তাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত তোমার লা‘নত অব্যাহত রাখ। আর প্রকৃতপক্ষে তারাই এর হকদার।
তিনি সর্বত্র ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনী মুসলিম ভাইদের স্বার্থ নিয়ে বিভিন্ন মজলিসে জোরালো বক্তব্য প্রদান করে থাকেন। তিনি দখলদার ইহুদী অবৈধ বসতি এবং যুলুমবাজ ইসরাঈল রাষ্ট্রকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্ত্ত করেন। তিনি বলেন, মসজিদুল আকসা বন্দী থাকতে পারে না। মসজিদুল আকসার মুক্তির ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করুন। স্বাধীন ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের পক্ষে জনমত তৈরী করুন। হিংসা-বিভেদ ভুলে আন্তরিকভাবে মজলুম ফিলিস্তিনীদের পক্ষে কথা বলুন।২০০৪ সালে লন্ডনে ১০ হাজার মানুষের সামনে তিনি একটি আন্তঃধর্মীয় খুতবা দেন। এসময়ে যুক্তরাজ্যের জাতিগত সমতা বিষয়ক মন্ত্রী এবং প্রধান রাব্বিও উপস্থিত ছিলেন।প্রিন্স চার্লসও এই খুতবাতে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে উপস্থিত ছিলেন।
চলমান করোনা মহামারীর মাঝেও সীমিত পরিসরে মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীর কার্যক্রম চালু রাখতে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি করোনা রোগীদের জমজমের পানি সরবরাহের আদেশ দেন।২০০৫ সালে দুবাইয়ে বর্ষসেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসাবে ‘ইসলামিক পারসনালিটি অব দ্য ইয়ার’ (Islamic Personality Of the Year) নির্বাচিত হন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...