পুতিনের হাতে নস্যাৎ চেচেন মুসলিমদের স্বাধীনতার স্বপ্ন
মো. আবু রায়হান:
পুতিনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রচণ্ড দারিদ্র্য ও বন্ধুদের উপহাস-তাচ্ছিল্যের মধ্যে। পুতিনের বাবা একটি কারখানায় কাজ করতেন এবং তাঁর দাদা ছিলেন একজন বাবুর্চি। তার সেই জীবনই তাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হওয়ার শক্তি দিয়েছে। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন ইস্পাত-দৃঢ় ব্যক্তি হিসেবে। সম্প্রতি তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। সেই সময় নিজের খরচ মেটাতে তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভার হিসাবেও কাজ করেছেন।
১৯৯৭ সালে বরিস ইয়েলেৎসিন যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তখন ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনে আসেন এবং তাঁকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা করা হয়।কেজিবির পরবর্তী সময়ে এ সংস্থাটি গঠন করা হয়েছিল।১৯৯৯ সালে নতুন বছরের প্রাক্কালে মি: ইয়েলেৎসিন প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ভ্লাদিমির পুতিনকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।২০০০ সালের মার্চ মাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মি: পুতিন অনায়াসে জয়লাভ করেন। দুই যুগ হতে চলল রাশিয়ার শাসনক্ষমতায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়া নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুতিনের নেতৃত্বে।
রাশিয়ার জন্মের পরের কথা-বরিস ইয়েলত্সিনের নেতৃত্বে ‘পোকায় খাওয়া’ ও রক্তসল্পতায় ভোগা রাশিয়ান ফেডারেশনের ছিল করুণ দশা। কিন্তু এবার দেশটির রাশ ধরেছেন ‘লৌহমানব’ ভ্লাদিমির পুতিন।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ৬টি মুসলিম দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। এতে চেচেনরা স্বাধীনতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।আর সুযোগ বুঝে স্বাধীনতা ঘোষণা করে চেচেনরা। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে ‘চেচেন রিপাবলিক অফ ইচকেরিয়া’। চেচনিয়া বর্তমানে রাশিয়ার একটি প্রজাতন্ত্র । আয়তন ১ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা ১৪ লাখ। চেচেনরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের সংখ্যা শতকরা ৭৫ ভাগ।
চেচনিয়ার ৯৫ শতাংশ নাগরিক মুসলিম।১৭ হাজার তিন শ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চেচনিয়ার রাজধানী শহর গ্রোজনি।
৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ইসলামী খিলাফত প্রথম দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে প্রবেশ করে। এসময় চেচনিয়াও ইসলামের সংস্পর্শে আসে। কিন্তু চেচনিয়ায় ইসলামের আনুষ্ঠানিক প্রচার ও প্রসার শুরু হয় প্রায় এক হাজার বছর পরে, ষোলশ শতকে। এরপর থেকেই চেচেনরা ধীরে ধীরে ইসলামের ছায়াতলে জড়ো হয়। তবে চেচনিয়ায় চেচেনদের নিজস্ব পৌত্তলিক ধর্মের প্রভাব থাকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত। কিন্তু সুফি ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর চেচেনদের মধ্যে ক্রমে ইসলামী জাতীয়তাবাদের জন্ম নেয়, যা একই সময় ককেশাসের স্থানীয় অন্যান্য মুসলিমদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল।
১৯৯৪ সালে চেচনিয়া ফিরে পেতে চেচেন বিদ্রোহীদের দমনে সৈন্য পাঠায় মস্কো। কিন্তু ভয়াবহ লড়াইয়ে পর ১৯৯৬ সালে পর্যুদস্ত হয়ে ফিরে আসে রুশ সেনা। ওই যুদ্ধই পরিচিতি পায় প্রথম ‘চেচেন ওয়ার’ হিসেবে।
হাজার হাজার সৈন্যের মৃত্যু, রুশ ফেডারেশনের আর্থিক বিশৃংখলা, ইয়েতসিলিনের শাসনের প্রতি অনাস্থা- সব মিলিয়ে ক্রেমলিন একসময় বাধ্য হয় চেচেনদের সাথে একটা বোঝাপড়া করতে। গোটা বিশ্ব রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ব্যর্থতা, সাধারণ মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি নিয়ে রাশিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। রাশিয়ার মান সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে যায়। পাঁচ-চৌদ্দ হাজার রুশ সেনা প্রাণ দেয় চেচেন যুদ্ধে, আহত হয় আরো অনেক। বহু সেনা চেচেনদের হাতে বন্দীত্ব বরণ করে। চেচেনদের ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। অন্তত এক লক্ষ মানুষ এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে, তবে তাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক চেচেন আর ইংগুশ।
১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে আবারও চেচনিয়ায় সেনা পাঠায় রাশিয়া। তুমুল লড়াইয়ের পর ২০০০ সালে চেচেন রাজধানী গ্রজনিকে বোমা মেরে কার্যত ধুলোয় মিশিয়ে দেয় রুশ বাহিনী।
রুশদের হাতে চেচেন রাজধানী গ্রোজনির পতন হলে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।একইসঙ্গে রুশ রাজনীতিতে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা পান পুতিন।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে চেচনিয়ায় রুশ আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর তিন শতাব্দীকালেও শেষ হয়নি চেচেন মুসলিমদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিন শতাব্দী ধরে চলতে থাকা চেচনিয়া ও চেচেনদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখানেই থমকে যাবে কি না - এমন প্রশ্ন রয়ে গেছে সবারই মনে। এর উত্তর দেবে সময়ই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন