সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইউক্রেনে মুসলিম

 


মো. আবু রায়হান:
ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। রাশিয়ার পরে এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র।আয়তন ছয় লাখ তিন হাজার ৬২৮ বর্গমাইল। ইউক্রেনের পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা, দক্ষিণে কৃষ্ণ সাগর ও আজভ সাগর।
নবম শতক থেকে ইউক্রেনের উত্তর অংশ কিয়েভান রুশের অংশ ছিল। কিয়েভান রুশ ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব স্লাভীয় রাষ্ট্র। ১৩শ শতকে মোঙ্গল আক্রমণে এটির পতন ঘটে। এর পর বহু শতাব্দী ধরে ইউক্রেন বিভিন্ন বিদেশী শক্তির পদানত ছিল। এদের মধ্যে আছে পোলান্ড ও রুশ সাম্রাজ্য। ১৯১৮ সালে ইউক্রেনে একটি বলশেভিক সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের চারটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের অন্যতম প্রজাতন্ত্র হিসেবে ইউক্রেন আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১লা ডিসেম্বর এক গণভোটে এটির প্রতি ইউক্রেনের জনগণ সমর্থন দেয়। ইউক্রেনের এই ঘোষণা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে একটি বড় ভূমিকা রাখে।
দেশের জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ মিলিয়ন। এদের বেশির ভাগ মানুষ খ্রিস্টান। ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুসারে ইউক্রেনে ২,৪৮,১৯৩ জন ক্রিমীয় তাতার, ৭৩,৩০৪ ভলগা তাতার, ৪৫,১৭৬ জন আজেরি, ১২,৩৫৩ জন উজবেক, ৮,৮৪৪ তুর্কি, ৬,৫৭৫ জন আরব এবং ৫,৫২৬ জন কাজাখ বাস করে।২০১২ সালের ফ্রিডম প্রতিবেদনে ইউক্রেনে ৫,০০,০০০ জন মুসলিম জনসংখ্যার হিসাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩,০০,০০০ ক্রিমীয় তাতার রয়েছে।২০১১ সালের পিউ ফোরামের একটি গবেষণায় ইউক্রেনীয় মুসলিম জনসংখ্যা ৩,৯৩,০০০ অনুমান করা হয়েছিল, কিন্তু ইউক্রেনের মুসলমানদের ক্লারিক্যাল বোর্ড দাবি করেছে যে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ইউক্রেনে ২০ লক্ষ মুসলমান ছিল। উম্মাহর মুফতি সাইদ ইসমাগিলোভের মতে, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ লক্ষ মুসলমান ইউক্রেনে বসবাস করতেন। ইউক্রেনে ইসলামের সুন্নি হানাফি মাযহাবের অনুসারী বেশি এবং ইউক্রেনীয় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্রিমীয় তাতার। ইউক্রেনের আদিবাসী অন্যান্য তুর্কি জনগোষ্ঠী, প্রধানত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে বসবাস করেন, তারা ইসলামের অন্যান্য ধরন অনুশীলন করে। এর মধ্যে রয়েছে ভলগা তাতার, আজেরিস, উত্তর ককেশীয় জাতিগোষ্ঠী এবং উজবেক। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মুসলমানের বাস ক্রিমিয়ার সীমানার দিকে। এ ছাড়া ভলহানিয়া ও পোডোলিয়া এলাকায় কিছু লিপকা, তাতার জনগোষ্ঠীর বসবাস আছে, যারা মুসলিম।এ অঞ্চলের বেশির ভাগ মুসলমান মূলত ক্রিমিয়ান তাতার।
ইউক্রেনে ইসলামের আগমনের ইতিহাস ক্রিমিয়ান তাতারদের সঙ্গে সম্পর্কিত।১৫ শতাব্দীতে ক্রিমিয়ার খানাট প্রতিষ্ঠার আগ থেকেই ইউক্রেনে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব ছিল।সপ্তম শতাব্দীর দিকে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে তুর্কি বংশোদ্ভূত কিছু মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল। তাদের বংশধররাই ১৫ শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ইউক্রেনে ক্রিমিয়ান খানাট প্রতিষ্ঠা করে। পরে অবশ্য এটি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সে সময় ক্রিমিয়ার বখছিসারাই শহরে ১৮টি মসজিদ ও বহু মাদ্রাসা ছিল, কিন্তু রাশিয়ার অত্যাচারে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মুসলিম ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়।
এরপর থেকে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে লাখ লাখ মুসলমানকে এই অঞ্চল থেকে বের করা হয়। পরে ১৯৮৯ সালে ক্রিমিয়ান তাতাররা তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন করতে শুরু করে। এরপর থেকে মুসলমানের সংখ্যা একটু একটু করে বাড়ছে। বর্তমানে সেখানে ১৬০টি মসজিদ আছে, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ছে। এ অঞ্চলের প্রথম মসজিদ হলো মসজিদ আর রহমান। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালে ইউক্রেনের কিয়েভ শহরের তাতারকা পাড়ায় মুসলমানদের জন্য প্রথম মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
বর্তমানে ইউক্রেনে মুসলিমদের কয়েকশ কমিউনিটি রয়েছে। এই কমিউনিটিগুলোতে সাধারণত নামাজের ঘর, কনফারেন্স হল, ইন্টারনেট ক্লাব, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ হল, খেলার মাঠ ও ইসলামি বইয়ের বিশাল গ্রন্থাগার থাকে। তাদের উদ্যোগে সব বয়সী মুসলিমদের ইসলামি শিক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় নওমুসলিমদের ইসলামি দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সেমিনারের আয়োজন করা হয়। করোনার সময় মুসলিম কমিউনিটিগুলোর উদ্যোগে দরিদ্র ও অসহায়দের মধ্যে খাবার বিতরণ কর্মসূচি, রক্তদান কর্মসূচি ইত্যাদি পালন করা হয়। এরই মধ্যে তারা ‘আসসালামু আলাইকুম’ নামে মুসলমানদের স্বতন্ত্র একটি রেডিও স্টেশন খুলতে সক্ষম হয়েছে। অনুরূপভাবে তাদের রুশ এবং আরবি ভাষায় ‘আর রায়েদ’ নামে সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক পত্রিকাও রয়েছে। রয়েছে ‘আনসার’ নামে একটি আলাদা সাংস্কৃতিক সংস্থা। ইউক্রেনে তাবলিগ জামাতের কাজও চালু রয়েছে।
ইউক্রেনের মুসলমানরা ইসলামের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজে আত্মনিয়োগ করে ইউক্রেন জুড়ে শান্তির দাওয়াত পৌঁছে দিচ্ছে। গত বছর সেখানকার মুসলমানদের উদ্যোগে পুরো ইউক্রেনে ২৪ ঘণ্টায় এক মিলিয়ন বৃক্ষ রোপণ করা হয়। এর আগে কয়েক বছর আগে, ইউক্রেনে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে রাজধানী কিয়েভের সড়কে ইসলামের পরিচয় তুলে ধরার জন্য মুসলমানরা বিভিন্ন সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। এর ফলে দেশটিতে ইসলামবিরোধী কার্যক্রম অনেকটাই কমে আসে। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে স্থাপিত ১৭টি সাইনবোর্ডে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও হাদিস লেখা রয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...