আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান

 

আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান ( ৬৪৬ – ৮ অক্টোবর ৭০৫) ছিলেন ৫ম উমাইয়া খলিফা। তিনি ৬৪৬ খৃস্টাব্দে হেজাজের মদিনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মারওয়ান বিন হাকাম তাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করে যাওয়ায় তিনি উমাইয়া বংশের পঞ্চম খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান তার বিচক্ষণতা ও কঠোরতার মাধ্যমে উমাইয়া সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি দৃঢ় রূপ প্রদান করেছিলেন। আসন্ন বিপদকে নস্যাৎ করে উমাইয়া বংশের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করায় তাকে রাজেন্দ্র (Father of Kings) বলা হয়ে থাকে। আব্দুল মালিক ৬৪৬ খৃস্টাব্দে মদিনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মারওয়ান বিন হাকাম তাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করে যাওয়ায় তিনি ৬৮৫ সালে উমাইয়া বংশের পঞ্চম খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। পি. কে. হিট্টি আবদুল মালিকের রাজত্বকাল সম্পর্কে বলেন,"আব্দুল মালিকের সময় দামেস্কের এই রাজবংশ শৌর্যবীর্য ও গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করে।"
সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পর আব্দুল মালিক বিভিন্ন বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ৬৮৭ সালে আল মুখতারের বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে অনারব মুসলমান ও ইরাকবাসী আরব মুসলমানদের বিদ্রোহ দমন করেন। ৬৮৯ সালে আমর বিন সাঈদ নিজেকে খলিফা হিসেবে দাবী করলে তিনি তাকে কৌশলে রাজপ্রাসাদে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন। পরবর্তীতে তিনি মুসয়াব, আবদুল্লাহ বিন যোবায়ের ও খারেজীদের বিদ্রোহ দমন করেন। তারপর তিনি কায়রোয়ানের কার্থেজ ও বার্কা অধিকারের মাধ্যমে উমাইয়া বংশের হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। তারপর রোমান সাম্রাজ্যের আর্মেনিয়া,সাইপ্রাস ও এশিয়া মাইনরের বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করেন।
আব্দুল মালিক সংস্কারের মাধ্যমে প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন ঘটান। তিনি শাসনব্যবস্থাকে আরবীয়করণের মাধ্যমে আরবীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটান। ফলে অনারবদের উপর আরবদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি আরবী ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেন। এ সময় সকল দলিল-দস্তাবেজ ও নথিপত্রে আরবী ভাষার প্রচলন ঘটে। তিনি নথিপত্রগুলো সংরক্ষণের জন্য দিওয়ানুর রাসায়েল নামক একটি আলাদা বিভাগ তৈরি করেন।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতানুসারে খলিফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামি দিনার তৈরি করেন এবং তিনিই প্রথম ইসলামি মুদ্রা প্রচলনের পূর্ণ মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং তিনিই সমগ্র পৃথিবীতে প্রধান ও প্রথম মুদ্রা তৈরি ও প্রচলনকারী হিসাবে পরিগণিত হয়েছেন। আধুনিক পরিভাষা অনুযায়ী ‘ইসলামি দিনার’ তখনকার ‘হার্ড কারেন্সি’তে পরিণত হয়েছিল।আরব বিশ্বে সে সময় স্বতন্ত্র ইসলামী মুদ্রার প্রচলন ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে ইরানি, রুমি এবং কিবতি মুদ্রার প্রচলন ছিল। নিজ মুদ্রার অভাব মুসলমানদের অর্থনৈতিক ক্ষতির অপরিহার্য কারণ হয়ে দেখা দেয়। আবদুল মালেক হিজরী ৭৬ সালে ইসলামী মুদ্রা চালু করার জন্য ‘টাকশাল’ কায়েম করেন, যার ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ভিত সুদৃঢ় হয়।একটি আধুনিক গবেষণায় ড. নাজদাহ খামাস বলেন, ‘সিরিয়ায় দিনার পাওয়া গিয়েছিল ১৯৫৪ সালে, এর পর লেবাননে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখান থেকে করাচির জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয় এবং এখনো সেখানেই আছে। এ আরবীয় নতুন দিনার তৈরি হয়েছিল ৭৪ হিজরি সনে। এর প্রথম পৃষ্ঠায় অঙ্কিত ছিল খলিফা আব্দুল মালিকের ছবি, দণ্ডায়মান, তরবারি হাতে, পরনে যুদ্ধের পোশাক। এর চতুর্দিকে লিখা ছিল বিপরীত দিক থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু’, ‘মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহ’ প্রথম পিঠের মধ্যখানে ছিল বাইজেনটাইন ক্রস, এর চতুর্দিকে লিখা ছিল ‘বিসমিল্লাহ’। এ দিনার হিজরি ৭৪ সনে তৈরি করা হয়েছিল।
আব্দুল মালেক সরকারী ফরমান ও চিঠিপত্রসমূহে ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ খুদাই করিয়েছিলেন এবং রাজা-বাদশাদের লিখিত পত্রাবলিতেও তা লিখিত হত। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একবার রুমক কায়সার খলিফা আবদুল মালেকের ইসলামী মুদ্রা তৈরির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং হুমকি প্রদান করেন যে, এ রীতি পরিহার করা না হলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, সুতরাং তা বর্জন করুন। এ প্রথা আপনার জন্য শুভ হবে না। আবদুল মালেক এ হুমকির প্রতিবাদে রুমি মুদ্রা বাতিল করে ইসলামী মুদ্রার প্রচলন করেন। আবদুল মালেকের ন্যায় দুঃসাহসী খলিফার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল রুমক সম্রাটের কঠোর হুমকির এরূপ কঠোর জবাব দান করা। তিনি রুমি মুদ্রার স্থলে ইসলামী মুদ্রা চালু করে তাতে ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ খোদাই করে দেন।
আব্দুল মালিকের অনুমতিতে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নোকতা ও হরকতের প্রচলনের মাধ্যমে আরবী ভাষা পড়ার অসুবিধা দূরীভূত করেন।
কুব্বাত আস সাখরা বা ডোম অফ দ্য রক কোন মসজিদ বা এবাদতখানা নয়। আরবিতে কুব্বাহ হলো গম্বুজ আর সাখরাহ হলো পাথর। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, “পাথরের (উপর নির্মিত) গম্বুজ”; হিব্রুতে বলে কিপ্পা হা-সেলা।
আব্দুল মালিক জেরুজালেমে কুব্বাতুস সাখরা (The Dome of the Rock) নির্মাণ করে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পকে অনবদ্য রূপ দান করেছেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন শহরও নির্মাণ করেছেন। তবে কুব্বাতুস সাখরা'ই স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কুব্বাতুস সাখরা অর্থ পাথরের উপর তৈরি করা গম্বুজ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে পাথরের উপর পদচিহ্ন রেখে মিরাজে গিয়েছিলেন সে পাথরটিকে কেন্দ্র করেই অষ্টকোণাকার এ স্মৃতিস্তম্ভটি তৈরি করা হয়েছিল। তবে এটি নির্মাণের পেছনে তার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সে সময় মক্কা ও মদিনা আব্দুল্লাহ বিন যোবায়েরের অধীনে থাকায় জেরুজালেমে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে তিনি এ ভবনটি নির্মাণ করেন।
সেকেন্ড টেম্পল বা দ্বিতীয় বাইতুল মুকাদ্দাস রোমানরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। রোমানরা সেখানে জুপিটারের মন্দির বানিয়েছিল, সেটির জায়গায় উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক এই ডোম অফ দ্য রক বা কুব্বাতুস সাখরাহ নির্মাণ করেন।
৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক এটি নির্মাণ করেন। এই স্থাপনাটি অষ্টাভুজাকৃতির। এটা মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন। এর নকশা এবং অলংকরণে সমসাময়িক বাইজেন্টাইন স্থাপত্যশৈলী এবং স্বতন্ত্র ইসলামিক ট্র্যাডিশনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল