শিক্ষায় হাজি মহসীনের অবদান

 




৩ জানুয়ারি কিংবদন্তীতুল্য দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের ২৮৯ তম জন্ম-বার্ষিকী।উপমহাদেশের ইতিহাসের এ বিখ্যাত দানবীর মুহাম্মদ মহসিন ১৭৩২ সালের ৩ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন।১৮১২ সালে এ ধার্মিক দানবীর হুগলিতে ইন্তেকাল করেন। তাকে হুগলির ইমামবাড়ায় দাফন করা হয়।অঢেল সম্পত্তির মালিক ছিলেন হাজী মহসিন। এসব সম্পদ তিনি দুহাতে অকাতরে বিলিয়ে গেছেন। মহসিনের পূর্ব পুরুষরা অত্যন্ত ধনী ছিলেন। ইরান থেকে বাংলায় আসা তার বাবা হাজী ফয়জুল্লাহ ছিলেন একজন ধনী জায়গিরদার।মাতা জয়নব খানমেরও হুগলি, যশোর, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় বিস্তর জমি ছিল। তার বোন মন্নুজানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হিসেবে মহসিন বোনের সম্পত্তির মালিক হন।এতো সম্পদের মালিক হয়েও মহসিন ছিলেন খুব ধার্মিক ও নিরহঙ্কারী। তিনি সর্বদা সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ইমাম বাড়া প্রাসাদে বাস করতেন না। ইমাম বাড়ির পাশে একটি ছোট কুটিরে বাস করতেন।আর কুরআন শরীফ নকল করে যা পেতেন তা দিয়েই চলতেন। নিজ হাতে রান্না করে অধিনস্তদের নিয়ে বসে খেতেন।
১৭৬৯-৭০ সালের সরকারি দলিল অনুযায়ী তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় হাজি মহসীন অনেক লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। মহসিন ফান্ড প্রতিষ্ঠাঅবশেষে তিনি মুসলমানদের সুশিক্ষায় ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘মহসিন ফান্ড’ নামক তহবিল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সমুদয় অর্থ এ ফাউন্ডেশনের জন্য দান করেন। এ ফান্ডের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য দুই জন মোতাওয়াল্লি নিয়োগ করেন। শুধু মোতাওয়াল্লি নিয়োগই নয়, মহসিন ফান্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য দানকৃত সম্পত্তিকে নয়ভাগে ভাগ করেন।তন্মধ্যে তিনভাগ সম্পদ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য। চারভাগ সম্পদ পেনশন, বৃত্তি ও দাতব্য কর্মকাণ্ডে খরচ করার জন্য এবং দুইভাগ সম্পদ মোতাওয়াল্লিদের পারিশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করেন। তাছাড়া তাঁর দানকৃত অর্থে অসংখ্য দারিদ্র্য ছাত্রের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। মুন্নুজান অথবা হাজী মুহাম্মদ মহসীনের দান করা সম্পত্তির পরিচালনা নিয়ে পরবর্তীতে কিছু মামলা-মোকদ্দমার তৈরি হয়। যাদের পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অবশেষ ১৮৩৪ সাল নাগাদ এই তহবিল ব্যবহারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা।
সেই সময় এই তহবিলের আকার ছিল পাঁচ শতাংশ সুদে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা আট লাখ আটানব্বই হাজার চারশো রুপি এবং নগদ পাঁচ হাজার দুইশ ৪৩ রুপি। সরকারি বন্ড থেকে বছরের আয় ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৪ রুপি। সেই সময়ের হিসাবে এটি অনেক টাকা।১৮৩৫ সালে এই তহবিল দিয়ে 'মহসিন এডুকেশনাল এনডাউমেন্ট ফান্ড' তৈরি করে ব্রিটিশ সরকার।
হাজী মুহাম্মদ মহসীন যেভাবে দানপত্র লিখেছিলেন, তাতে কিছু পরিবর্তন এনে ব্রিটিশরা দুইটি আলাদা তহবিল গঠন করে। তার একটিতে হাজী মহসিনের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে ব্যয় যেমন শিয়া ধর্মকেন্দ্র ইমামবাড়ার খরচ, পেনশন প্রদান ও মোতোয়ালির বেতন ইত্যাদি খাতে ব্যয় হবে। সাধারণ ফান্ড নামের আরেকটি ফান্ড থেকে শিক্ষার পেছনে ব্যয় হবে।
পরবর্তীতে এই তহবিল থেকে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ। ট্রাস্টের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলী মহসিন কলেজ এবং এই কলেজের সাথে হাজী মুহসীনের অর্থে পূর্বে নির্মিত দুটি স্কুলকে মিলিয়ে দেয়া হয়। উল্লেখ্য এইটিই ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা র কলেজ যেখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে-কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। এর আগে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ ছিল শুধু ‘the sons of respectable Hindoos’ এর জন্য এবং ১৮১৮ ও ১৮২০ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ ও বিশপস কলেজ ছিল খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য। হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা, সিতাপুর মাদ্রাসা, ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মহসিন হল’ এবং ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ঘাঁটি ‘বিএনএস হাজি মহসিন’ও তাঁর স্মরণে নামকরণ করা হয়। জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে রয়েছে মহিপুর হাজি মহসিন সরকারি কলেজ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, স্যার উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, শরৎচন্দ্র টট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভুবনবিশ্রুত বাঙ্গালিরা সবাই এই হুগলী মহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং মহসিন ফান্ডের বৃত্তি ব্যবহার করেছেন । অবশ্য ১৮৩৫ সালে ইংরেজ সরকার এর নাম হুগলী মহসিন কলেজ রাখলেও কোনো অব্যাখ্যেয় কারণে দিনে দিনে মানুষের বলায় ও লেখায় এর নামটি দাঁড়ায় শুধু হুগলী কলেজ। মুহসীন শব্দটি ঝরে পড়ে যায়। ১৮৬০ সালের পরে কোনো কাগজপত্রে কিংবা সাইনবোর্ডে আর মহসীন নামটা দেখাই যায় না। ১৯৩৬ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় কলেজটি মূল নামে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সে দাবি অনুযায়ী সরকারিভাবে পুনরায় কলেজটির নাম হয় হুগলি মহসিন কলেজ।
এই তহবিল থেকে একটি শিক্ষাবৃত্তিও চালু করা হয়, যা মেধাবী কিন্তু দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য আজও সহায়তা দিয়ে আসছে।নবাব আব্দুল লতিফ, খাজা আব্দুল গনি, তাদের চেষ্টায় ১৮৭৩ সালে এই ফান্ড থেকে স্কলারশিপ চালু করা হয়। শুধু এটাই না, তখনকার স্কুলগুলোয় একজন আরবি শিক্ষকসহ বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রদের শিক্ষার ব্যাপারে এই ফান্ড থেকে সহযোগিতা আসতো।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল