নয়া যামানার এজিদ
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আধুনিক সৌদি গঠনে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেন ২০১৬ সালে। সাইকেল-বাইক-গাড়ি চালানো, ব্যবসা, একা একা হোটেলে থাকার স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সুইমিংপুল-ম্যাসাজ পার্লারের মতো নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে উঠে যায় ধর্মীয় ফতোয়া।২০১৮ সালে ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে রিয়াদে প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা হল চালু হয়। যেখানে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’ সিনেমা মুক্তি পায়। সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ের সিনেমা দেখার অনুমোদন দেয় সৌদি সরকার।
একই বছর সৌদি আরব প্রথমবারের মতো কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশ নেয়। ২০১৮ সালে সৌদি প্রথমবারের মতো ভেনিস আর্কিটেকচার বিয়েনলে অংশ নেয়। এ বছর রিয়াদের ফর্মুলা রেসে প্রথম আন্তর্জাতিক পারফরমারদের মধ্যে এনরিক ইগলেসিয়াস, আমর দিয়াব এবং ব্ল্যাক আইড পিস অংশ নেয়, যাদের জন্য প্রথম পরীক্ষামূলক ট্যুরিস্ট ভিসা মঞ্জুর করা হয়। এ বছরই সৌদিতে প্রথম শীতকালীন ট্যান্টোরা ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অভিনেতা এবং বিশ্বের দর্শনার্থীদের আলুলায় নিয়ে আসা হয়।
২০১৯ সাল থেকে সৌদি আরবজুড়ে গানের উৎসব হয়। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠানে পিটবুল এবং আকনের মতো আন্তর্জাতিক তারকারা সংগীত পরিবেশনা করেন।
২০২০ সালে ডেজার্ট এক্স আলুলার প্রথম সংস্করণে সৌদি থেকে শিল্পীদের ১৪টি বড় আকারের ভাস্কর্য প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হাতে নেয়। যেখানে সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকার শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন।
২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ৩৫০টি সিনেমা হল এবং দুই হাজার ৫০০ মুভি স্ক্রিন তৈরির লক্ষ্য স্থির করেছে ক্রাউন প্রিন্স সালমানের সরকার।
একসময় সিনেমা হলই নিষিদ্ধ ছিল যে দেশে, সেই সৌদিতে সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস। ইসলামি রাজতন্ত্রের রাষ্ট্রটিতে ২০২১ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হল বড় মাপের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। ডিসেম্বরের ৬ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত লোহিত সাগরের শহর জেদ্দায় চলে ‘রেড সি চলচ্চিত্র উৎসব’। জর্ডান, সৌদি আরব, লেবানন, তিউনিশিয়া, মিসরসহ ৬৭ দেশের ৩০টিরও বেশি ভাষার ১৩৮টি পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় এই উৎসবে।
২০১৫ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা প্রায় ১৫০ জন নারী মালদ্বীপের একটি ব্যক্তিগত দ্বীপে পৌঁছেন। মধ্যপ্রাচ্যের ‘কয়েক ডজন’ পুরুষের সঙ্গে পার্টি করতে সেখানে যান তারা।সেই পার্টির আয়োজক ছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তখন ২৯ বছর বয়সী সৌদি যুবরাজ দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব ছিলেন। তার আয়োজনে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে মালদ্বীপের ‘ভেলা’ নামের একটি ব্যক্তিগত দ্বীপে প্রায় এক মাস ধরে পার্টি চলে। ‘ভেলা’কে বলা হয় ‘বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল ও ব্যয়বহুল’ দ্বীপ।
ওই দ্বীপে প্রায় চার ডজন ব্যক্তিগত বাগানবাড়ি আছে, অনেকগুলো ভারত মহাসাগরের নীল পানির ওপর নির্মিত।কোয়ার্টারে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ডেক ও সুইমিং পুল আছে। অতিথিদের প্রত্যেকেই নিজস্ব গৃহ পরিচারিকা নিয়ে সেখানে এসেছিলেন।এমনকি, সেখানে একটি তুষার মেশিনও আনা হয় যাতে করে দর্শনার্থীরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সৈকতে কৃত্রিম বরফখণ্ড তৈরি করে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।এমবিএস হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমান পুরো দ্বীপটি ভাড়া নিয়েছিলেন। দ্বীপটি ছিল তার ও তার অতিথিদের দখলে।মালদ্বীপের এই ‘ভেলা’ দ্বীপ যুবরাজ সালমান এক মাসের জন্যে ভাড়া নিয়েছিলেন ৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে।এতে খরচ হয় প্রায় পাঁচ কোটি ডলার।
সৌদি আরব হারামাইন শরিফাইনের দেশ। মুসলিম বিশ্বের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার দুই নগরী এ দেশেই অবস্থিত। এখানকার আচার-সংস্কৃতি তাই অনেকটাই ইসলাম-বান্ধব। ইসলাম-বান্ধব এ সমাজটাকে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার তকমা দিয়ে এখানকার সুন্দর অনাবিল পরিবেশটাকে দূষণীয় করার উদ্যোগ নেন মুহাম্মদ বিন সালমান। দেশটিতে প্রকাশ্যে সিনেমা দেখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না, সালমান সিনেমা হল তৈরির মাধ্যমে পাপ কাজের এ পথকে সুগম করে দিয়েছেন। নারী-স্বাধীনতার নাম করে পর্দাপ্রথাকে করেছেন শিথিল। এবং আরও নানা রকম শরিয়াহ-বিরোধী কর্মকা-ের বিস্তার ঘটিয়েছেন, যা সৌদি সমাজ কল্পনাও করেনি কখনও।
তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদ করারও সুযোগটুকু নেই। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যারাই প্রতিবাদ করতে গেছেন, তাদেরকেই বরণ করতে হয়েছে বন্দিত্ব। কাবা শরিফের অন্যতম ইমাম শায়খ সালেহ আল তালিবের কথাই ধরা যাক। মুহাম্মদ বিন সালমানের শরিয়াহ-বিরোধী এসব কর্মকা-ের বিরোধিতা করে গত বছরের আগস্টে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। ব্যস, আর যায় কোথায়! সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার। সৌদি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কীভাবে কাটছে তাঁর জীবন, কেউ জানে না। আলেমদের ওপর এ নিপীড়ন অবশ্যি নতুন নয়। অতীতে আরও অনেক অমিততেজা আলেম সৌদি রাজপরিবারের শরিয়াহ-বিরোধী বিভিন্ন কর্মকা-ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এভাবে বন্দি হয়েছেন। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড নিয়ে তাঁদের জীবন কাটছে কারাগারের ভেতর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন