সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কলকাতা মাদ্রাসা ও প্রথম অধ্যক্ষ



১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় ইংরেজ শাসন। ক্ষমতায় এসেই তারা শিক্ষা, সংস্কৃতির দিকে বিশেষ নজর দেয়। তারা জানতো টেকসই ক্ষমতার জন্য এগুলো অপরিহার্য। অন্যদিকে রাজত্ব, শাসন ক্ষমতা, সামাজিক মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রসমূহ। যার ফলে বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী পিঁছিয়ে পড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।ম্যাক্সমুলারের মতে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৮০ হাজার মাদ্রাসা চালু ছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার বাংলা দখল করে মসজিদ-মাদ্রাসার খরচ নির্বাহের জন্য বরাদ্দকৃত ‘ওয়াক্ফ সম্পত্তি’ বাজেয়াপ্ত করলে মাদ্রাসাগুলো ধীরে ধরে বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে ও ইংরেজদের প্রয়োজনে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ১ অক্টোবর (শাবান, ১১৯৪ হি.)সনে ফোর্ট উইলিয়ামের গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক কলকাতায় কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।১৭৮১ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত আলিয়া মাদ্রাসা বোর্ড অব গভর্নরস’ দ্বারা এবং ১৮১৯ থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ইংরেজ সেক্রেটারি ও মুসলমান সহকারী সেক্রেটারির অধীনে ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৮৫০ সালে আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি হলে ড. এ. স্প্রেংগার মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ২৬ জন ইংরেজ এ পদ অলঙ্কৃত করেন। এলায়স স্প্রেংগার বা এ স্প্রেংগার একজন বিভিন্ন ভাষায় পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। শোনা যায় তিনি ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষাসহ প্রায় ২৫টা ভাষায় দক্ষ ছিলেন।একজন শিক্ষাবিদ, লেখক ও ইসলামী গবেষক। তিনি ইসলাম ও হজরত মুহাম্মাদ (সা) এর জীবনীর উপর বই লিখেছেন। ডঃ এ স্প্রেংগার ব্রিটিশ শাসনের সূত্রধরে ১৮৪৩ সালে ভারতবর্ষে আগমন করেন।এদেশে ব্রিটিশ সরকারকে শিক্ষা কাজে সাহায্য করার জন্য এলায়স স্প্রেংগার আগমন করেন।

১৯২৭ সালে প্রথম মুসলিম ব্যক্তি খাজা কামালউদ্দীন আহমদ অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ২৭ তম অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষা বেগবান হয়, এবং মাদ্রাসায় মুসলিমদের প্রভাব তৈরি হতে থাকে।শামসুল উলামা খাজা কামালউদ্দীন আহমদ একজন ইসলামী শিক্ষাবিদ, গবেষক। তিনি তৎকালীন আই.ই.এস ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।১৮৫০ মাদ্রাসাটিতে অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি হলেও ৭৭ বছর পরে কোন মুসলিম এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ লাভ করেন, এরমধ্যে ২৬ জন ইংরেজ পণ্ডিত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।কামালউদ্দিন মাদ্রাসাটিতে দায়িত্ব গ্রহণ করলে এই বছরই অন্যান্য মাদ্রাসার সঙ্গে কলকাতা মাদ্রাসাতেও আলিম, ফাজিল, কালিম, মুমতাজুল মুহাদ্দেসিন প্রভৃতি শিক্ষাক্রমের সূচনা ঘটে এবং মাদ্রাসাটিতে ইসলামী শিক্ষার ব্যপক উন্নয়ন সাধিত হয়।
১৯৪৭ দেশ ভাগ হয়ে গেলে ভারত ও বাংলাদেশ আলাদা স্বতন্ত্র দেশে পরিণত হয়, ফলে অবধারিত ভাবে মাদ্রাসা-ই আলিয়াকে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এবং নামকরণ করা হয় মাদ্রাসা-ই আলিয়া, ঢাকা। কলকাতা আলিয়া ঢাকায় স্থানান্তরিত হলেও কলকাতায় এখনো আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে মাদরাসা বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৬১ সালে মাদ্রাসা ঢাকার লক্ষ্মীবাজার থেকে বখশীবাজারে স্থানান্তরিত হয়, লক্ষ্মীবাজারে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে নজরুল কলেজ)-এ মাদ্রাসার কার্যক্রম চলতে থাকে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ১৯৫৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকার বখশীবাজারে মাদ্রাসার চারতলাবিশিষ্ট নতুন ভবন ও ছাত্রাবাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।হলটি বর্তমানে আল্লামা কাশগরী রহ. হল নামে পরিচিত।ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক (১৮৯৫-১৯৫৮)।খান বাহাদুর মোহাম্মদ জিয়াউল হক যিনি খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক নামেও পরিচিত। শিক্ষাবিদ, কলকাতা মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ এবং ঢাকার মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন।খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক ১৮৯৫ সালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মুহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ আমানত আলী। ১৯১৩ সালে চাহারাম কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পয়ে সরকারি টেলেন্টপুল বৃত্তি লাভ করেন। ১৯১৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম নগরের মিউনিসিপাল স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯২১ সালে বিএ পাস করেন। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবিতে এবং ১৯২৪ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন ফার্সিতে । খান বাহাদুর মাওলানা জিয়াউল হক ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ও ফার্সি বিভাগ খোলার পর তিনি ওই বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯২৬ সালে তিনি ফেনী সরকারি কলেজ এবং ১৯২৭ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আরবি ও ফার্সির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৩০ সালে রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা, ১৯৪১ সালে হুগলি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ১৯৪৩ সালে কলকাতা মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তার নেতৃত্বেই কলকাতা মাদ্রাসা-ই-আলিয়া ভাগ হয় এবং মাদ্রাসাটি ঢাকার সাবেক ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) স্থানান্তর করা হয়। তার সময়ে মাদ্রাসায় ইলমে কেরাত ও তাজবিদ বিভাগের প্রবর্তন করা হয়। মোহাম্মদ জিয়াউল হক পূর্ব বাংলা সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের রেজিস্ট্রার, বেঙ্গল মাদ্রাসা বোর্ডের সহ-সভাপতি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ও একাডেমিক কমিটির সদস্য, এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য, শিক্ষা সংক্রান্ত মওলা কমিটি ও খোদাবখস কমিটি এবং মুয়াজ্জম কমিটির সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ১৯৫৪ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাওলা ব্রাদার্স। ১৫ এপ্রিল ১৯৫৮ সালে ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...