সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত দুটি জাতি


আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রধান ৬টি প্রাচীন জাতির মধ্যে পঞ্চম জাতি হ’ল ‘আহলে মাদইয়ান’। ‘মাদইয়ান’ হল লূত সাগরের নিকটবর্তী সিরিয়া ও হিজাযের সীমান্তবর্তী একটি জনপদের নাম। যা অদ্যাবধি পূর্ব জর্ডনের সামুদ্রিক বন্দর মোআন -এর অদূরে বিদ্যমান রয়েছে।আহলে মাদইয়ান-কে পবিত্র কুরআনে কোথাও কোথাও ‘আসহাবুল আইকাহ’ বলা হয়েছে। যার অর্থ ‘জঙ্গলের বাসিন্দাগণ’। এটা বলার কারণ এই যে, এই অবাধ্য জনগোষ্ঠী প্রচন্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে নিজেদের বসতি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে আল্লাহ তাদেরকে সেখানেই ধ্বংস করে দেন। এটাও বলা হয় যে, উক্ত জঙ্গলে ‘আইকা’ বলে একটা গাছকে তারা পূজা করত। যার আশপাশে জঙ্গল বেষ্টিত ছিল।হযরত শোয়াইব (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে। ইনি হযরত মূসা (আঃ)-এর শ্বশুর ছিলেন। কওমে লূত-এর ধ্বংসের অনতিকাল পরে কওমে মাদইয়ানের প্রতি তিনি প্রেরিত হন । চমৎকার বাগ্মিতার কারণে তিনি ‘খাত্বীবুল আম্বিয়া’ (নবীগণের মধ্যে সেরা বাগ্মী) নামে খ্যাত ছিলেন।হযরত শো‘আয়েব (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১০টি সূরায় ৫৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

মাদইয়ানবাসী পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পারস্পরিক লেনদেনের সময় ওজনে কম দিয়ে মানুষের হক আত্মসাৎ করত। দুর্নীতি, রাহাজানি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও মজুদদারির মতো জঘন্য অন্যায় কাজ তাদের সমাজের মধ্যে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এসব পাপে তারা এমনভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা কখনো মনে করত না যে, এসব কাজ অত্যন্ত জঘন্য বা গর্হিত। বরং তারা এসবের জন্য গর্ববোধ করত। মাদইয়ান সম্প্রদায়কে সুপথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ তায়ালা শোয়াইব (আ.)-কে তাদের কাছে পাঠান। হযরত শোয়াইব (আ.) সর্বপ্রথম তাদের তাওহিদের দাওয়াত দিলেন। তিনি তাদের বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহতায়ালার ইবাদত কর, যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই।’ তাওহিদের দাওয়াত দেওয়ার পরপরই হযরত শোয়াইব (আ.) তাদের ওজনে কম দেওয়ার জঘন্য মানসিকতাকে ত্যাগ করার উপদেশ দিলেন।
তিনি তাদের ওজনে কম না দেওয়ার অনুরোধ জানালেন। তিনি আরও বলেন, আজ আমি তোমাদের সচ্ছল ও ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি তোমাদের ব্যাপারে পরিবেষ্টনকারী দিনের আজাবের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। হে আমার কওম! ওজনে কম দিও না এবং লোকদের সঙ্গে প্রতারণা কোরো না। আর সমাজের বুকে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি কোরো না।
এ থেকে বোঝা যায়, ওজনে কম দেওয়া যেমন হারাম, তেমনি অপরের অধিকারে হস্তক্ষেপ করাও হারাম। হযরত শোয়াইব (আ.) তাদের আরও উপদেশ দিলেন, মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার জন্য রাস্তাঘাটে ওঁৎ পেতে অপেক্ষা কোরো না। কিন্তু উপদেশের বিনিময়ে কেবল উপহাস-পরিহাসই পেয়েছেন শোয়াইব (আ.)। অবশেষে তারা যখন সীমালঙ্ঘন করে ফেলল তখন আল্লাহ তায়ালার গজব এসে গেল। কয়েক দিন তাদের অঞ্চলে প্রচ- গরম পড়ল। গরমে তারা ছটফট করতে লাগল। অতঃপর কাছাকাছি একটা ময়দানের ওপর গাঢ় মেঘমালা দেখা দিল। ময়দানে মেঘের ছায়া পড়ল। শীতল বাতাস বইতে লাগল। এলাকার সবাই ওই ময়দানে উপস্থিত হলো। বলতে লাগল, এই মেঘ থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে। কিন্তু তাদের ওপর অগ্নিবৃষ্টি শুরু করল। আর নিচের দিকে শুরু হলো প্রচ- ভূমিকম্প। ফলে সবাই সেখানে ধ্বংস হয়ে গেল।মাদায়েন জাতিকেও ভূমিকম্প দ্বারা ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের গুরুতর কয়েকটি অপরাধ হলো- এক আল্লাহর আনুগত্য না করা, মাপে কম দেওয়া, সম্পদ আত্মসাৎ করা, মানুষকে ধর্মপালনে বাঁধা প্রদান করা।

কওমে সামুদ আরবের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় বসবাস করত। তাদের প্রধান শহরের নাম ছিল ‘হিজ্র’ যা শামদেশ অর্থাৎ সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে একে সাধারণভাবে ‘মাদায়েনে সালেহ’ বলা হয়ে থাকে। ‘আদ জাতির ধ্বংসের পর সামুদ জাতি তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়।সামুদ জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে কুরআনের নয়টি সূরার মাঝে। যথা- আল আরাফ, হুদ, আল হিজর, আন নম্‌ল, আল মুরসালাত, আন-নাজম, আল ক্কামার, আল হাক্কাহ, আশ-শাম্‌স।
সামুদ জাতি শিল্প ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আদ জাতির পর তারাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী জাতি। কিন্তু তাদের জীবনযাপনের মান যতটা উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল, মানবতা ও নৈতিকতার মান ততই নিম্নগামী ছিল। একদিকে উন্মুক্ত প্রান্তরে পাথর খোদাই করে করে প্রাসাদের পর প্রাসাদ তৈরি হচ্ছিল, অন্যদিকে সমাজে কুফর, শিরক ও পৌত্তলিকতার প্রসার ঘটছিল। অন্যায় ও অবিচারে সমাজ জর্জরিত হতে থাকে। সমাজে চরিত্রহীন লোকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। হজরত সালেহ (আ.) যে সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন, তাতে নিম্ন শ্রেণির লোকেরাই সাড়া দেয়।
সালেহ (আ:) কুরআনের বর্ণনা অনুসারে, তিনি ছিলেন একজন নবী। যাকে 'সামূদ জাতির' উদ্দেশ্যে আল্লাহ প্রেরণ করা হয়েছিল। সালেহ (আ:) এর নাম চারটি সূরায় ৯ স্থানে উল্লেখ আছে।
সালেহ (আ.) সারা জীবন তাদের হেদায়েতের পথে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে অল্প কিছু সঙ্গী ছাড়া গোটা জাতি তার অবাধ্যই থেকে যায়। একপর্যায়ে তারা দাবি করে, আপনি যদি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের ‘কাতেবা’ নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী মাদি উট বের করে দেখান। এটি দেখাতে পারলে আমরা আপনার ওপর ইমান আনব। সালেহ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহর কুদরতে পাহাড় থেকে একটি অদ্ভুত রকমের মাদি উট বের হয়। তা দেখে কিছু লোক ইমান আনে। কিন্তু তাদের সর্দাররা ইমান আনেনি, বরং তারা সে মাদি উটকে হত্যা করে ফেলে। এতে সালেহ (আ.) তার জাতির ওপর আল্লাহর আজাব নেমে আসার ঘোষণা দেন। তিনি তাদের সতর্ক করে দেন যে তিন দিন পরই আল্লাহর আজাব তোমাদের ধ্বংস করে দেবে।
নির্ধারিত সময়ে আসমানি আজাব এসে অবিশ্বাসীদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারপর সীমা লঙ্ঘনকারীদের মহানাদ আঘাত করে। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে (ধ্বংস হয়ে যায়)। যেন তারা কখনোই সেখানে বসবাস করেনি। উদ্ধত সামুদ জাতির প্রতি হজরত সালেহ (আ.)-এর হুঁশিয়ারি সত্যি বাস্তবায়িত হয়েছে। হঠাৎ একদিন প্রচণ্ড শব্দে ভূমিকম্প তাদের নাস্তানাবুদ করে ফেলে। বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়ে যায়। অবশেষে তাদের অপমৃত্যু ঘটে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...