মুসলিম বিশ্বের অহঙ্কার আবদুল কাদির খান
মো. আবু রায়হান-
আবদুল কাদির খান ছিলেন পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক ও একজন ধাতুবিদ্যা প্রকৌশলী।
পাকিস্তানের সমন্বিত পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের জন্য এইচইইউ ভিত্তিক গ্যাস-সেন্ট্রিফিউস ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করা হয়।
আবদুল কাদির খানের জন্ম ভারতের ভুপালে, ১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের তিক্ত স্মৃতি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে পাকিস্তানে পাড়ি জমান তিনি।
বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন কাদির খান। ১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে পাড়ি জমান ইউরোপে। জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনা শেষে অ্যাংলো-ডাচ-জার্মান পারমাণবিক প্রকৌশল কনসোর্টিয়াম ইউরেনকোতে কাজ করেন। মূলত সেখান থেকেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার প্রক্রিয়ার খুটিনাটি বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন পাকিস্তানি এই বিজ্ঞানী।
আবদুল কাদির খানকে পাকিস্তানিরা ‘একিউকে’ বলেন। পাকিস্তানে দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। ভালোবেসে তাঁকে ‘মহসিন-ই-পাকিস্তান’ বলা হয়। অর্থাৎ, তিনি হলেন ‘পাকিস্তানের কল্যাণকারী। দেশের প্রতি অবদানের জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব নিশান-ই-ইমতিয়াজ পেয়েছেন তিনি।এছাড়া পাকিস্তানের সব বেসামরিক খেতাব রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। অন্যদিকে, পশ্চিমাদের চোখে তিনি ছিলেন বিপজ্জনক ব্যক্তি। তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন দেশের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাচারের মতো বিপজ্জনক পথে হেঁটেছেন আবদুল কাদির খান। আবদুল কাদির খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকেই ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার কাছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছেন। এ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারকে তথ্য-প্রমাণ দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে একটি স্বীকারোক্তি দেওয়ার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ তাকে ক্ষমা করলেও বেশ কয়েক বছর ইসলামাবাদের নিজ বাড়িতে তাকে গৃহবন্দি করে রাখেন।পরবর্তী সময়ে আবদুল কাদির খান বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে সব ধরনের উপকরণ পাকিস্তানের একার পক্ষে বানানো সম্ভব ছিল না। তাই এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।২০০৯ সালে আদালতের আদেশে আবদুল কাদির খানের গৃহবন্দিত্বের অবসান ঘটে। কিন্তু অবাধে চলাফেরা করতে পারতেন না তিনি। ইসলামাবাদের বাইরে যেতে হলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো। সব সময় তাঁর ওপর নজর রাখা হতো। ২০০৮ সালে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি পাকিস্তানকে দুই বার রক্ষা করেছি। প্রথমবার, পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করার মাধ্যমে। আর দ্বিতীয়বার, পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি পাচারের দায় পুরোপুরি নিজের কাঁধে নিয়ে।গত
রোববার স্থানীয় সময় সকালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের তার মৃত্যু হয় বলে পাকিস্তানের ডন নিউজ জানিয়েছে।রেডিও পাকিস্তানের বরাত দিয়ে ডন জানায়, ভোরে ৮৫ বছর বয়সী বিজ্ঞানীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। ফুসফুসের সমস্যায় আক্রান্ত কাদির খানকে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান টুইট বার্তায় বলেন, 'ড. এ কিউ খানের ইন্তেকালে আমি গভীরভাবে শোকাহত। আমাদেরকে পরমাণু অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত করতে তার অনস্বীকার্য ভূমিকার কারণে তিনি আমাদের জাতির ভালোবাসার পাত্র। এর মাধ্যমে পরমাণু অস্ত্রধারী বৃহত্তর প্রতিবেশীর আগ্রাসন থেকে আমরা নিরাপত্তা লাভ করেছি। পাকিস্তানের জনগণের কাছে তিনি এক জাতীয় প্রতীক।'
পেছনের কথা -১৯৭৪ সালে ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণ উপমহাদেশের সামরিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এর ফলেই ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানকে স্থাপন করতে হলো ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ল্যাবরেটরি, যেখানে মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই পাকিস্তান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ক্ষমতা অর্জন করল। ১৯৭৮ সালে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করেন তাঁরা। এর পরও কিছুটা সময় নেওয়া হয়। চলতে থাকে গবেষণার কাজ। চূড়ান্ত সফলতা আসে ১৯৯৮ সালে।১৯৯৮ সালের ১১-১৩ মে ভারতের পরমাণু বোমা পরীক্ষার জবাবে ২৮ ও ৩০ মে পাকিস্তানের পরমাণু বোমা পরীক্ষায় রাতারাতি পাকিস্তানের জাতীয় নায়কে পরিণত হন আবদুল কাদির খান। একইসাথে মুসলিম বিশ্বেও তিনি বিপুলভাবে সমাদৃত হন।তিনি পারমানবিক শক্তি উদ্ভাবন করে সারাবিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহকে স্তব্ধ করে দিয়ে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য এনে দিয়েছিলেন। আবদুল কাদির বেলুচিস্তানের চাখাই পাহাড়ে এমন একটি পারমাণবিক বিস্ফোরণমালা ঘটিয়েছেন, যার প্রতিটি বোমা হিরোশিমার বোমা থেকে ৮০ গুণ বেশি শক্তিশালী, যা পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যে কেন্দ্রীয় দিল্লির সাত বর্গকিলোমিটারের পরিধিতে বসবাসকারী নয় লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
২০০১ সালে, অবসর হওয়ার পর্যন্ত তিনি একজন সাধারণ-পরিচালক এবং ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ছিলেন এবং অন্যান্য বিজ্ঞান প্রকল্পে তিনি একটি প্রাথমিক এবং প্রাণপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
পাকিস্তানিদের চোখে ড. কাদির খান 'জাতীয় বীর'। দেশটির ইতিহাসে তার নাম উচ্চারিত হবে গৌরবের সঙ্গে। তিনি সামরিক শক্তির দিক থেকে পাকিস্তানকে তুলে এনেছেন নতুন উচ্চতায়। পাকিস্তানকে বিশ্বের প্রথম পরমাণু শক্তিধর মুসলিম দেশ বানানোর কৃতিত্ব আবদুল কাদির খানের।
ড. কাদির খান এমন একজন পরমাণু বিজ্ঞানী যিনি সব সময়ই ইসরায়েলের শত্রুদের সহযোগিতা করেছিলেন। কৌশলগত সামরিক সক্ষমতার বৈশ্বিক চিত্র বদলে দিয়েছিলেন। অথচ, মোসাদ তাকে হত্যা করেনি।শুধু তাই হয়, এমন চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরও তিনি গুপ্তহত্যা থেকে বেঁচে গেছেন।এই ব্যক্তি পশ্চিমাদের কাছে একজন ভয়ঙ্কর মানুষ। এমনটাই বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র সাবেক পরিচালক জর্জ টেনেট।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন