পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা
পবিত্র আখেরি চাহার শোম্বা আজ। আখেরি চাহার শোম্বা মূলত আরবি ও ফার্সির যুগল শব্দ। আখেরি অর্থ শেষ। চাহার অর্থ সফর মাস এবং শোম্বা অর্থ বুধবার। অর্থাৎ সফর মাসের শেষ বুধবার হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর সাময়িক সুস্থতাকে স্মরণ করে মুসলমানরা যে ইবাদত করেন, তাই আখেরি চাহার শোম্বা।
রোগ-শোক মানব জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার, এতে মানুষের পরীক্ষা নিহিত থাকে। তবে কিছু কিছু রোগ-পীড়া এমনও আছে, যা কখনও বিস্মৃত হওয়া যায় না। প্রাণপ্রিয় নবী হযরত রসুলুল্লাহ (সা.) এর পীড়া এমন ছিল না যা সহজে বিস্মৃত হওয়া যায়। তিনি পীড়িত হয়ে পড়লে তখনকার মুসলমানগণ কি নিদারুণভাবে উৎকণ্ঠা ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তার বিবরণ ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইন্তেকালের পূর্বে কোন তারিখে তাঁর পীড়ার সূত্রপাত হয়েছিল তা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। এ সম্পর্কে ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে : ‘অধিকাংশ বর্ণনানুযায়ী পীড়ার মোট সময় ১৮ সফর বুধবার হতে শুরু করে ১৩ দিন হয়’ (ইবন হিশাম, পৃ. ৯৯৯)।
আখেরী চাহার সোম্বা সম্বন্ধে বলা হয় যে, নবী (সা.) এই দিনে তাঁহার পীড়ায় কিছুটা উপশম বোধ করেছিলেন এবং গোসল করেছিলেন। এইদিনের পর আর তিনি গোসল করতে পারেননি। কারণ তৎপর তাঁর পীড়া বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। সবশেষে ১২ রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।
ইবনে ইসহাক তার সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থে বলেছেন, সফর মাসের শেষ কী রবিউল আউয়াল মাসের শুরুতে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আল্লাহর সম্মানজনক সান্নিধ্যে অন্তিমযাত্রার অসুখ শুরু হয়। ওই সময়ে এক মধ্যরাতে তিনি গিয়েছিলেন বাকিউল গারকাদের কবরস্থানে। সেখানে মৃত ব্যক্তিদের জন্য তিনি মোনজাত করেন। ভোরে ঘরে ফিরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওই অসুখ যে তাঁর মৃত্যুযাত্রার সূচনা, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তার মুক্ত ক্রীতদাস আবু সওয়ায় হিবার কথোপকথন থেকে বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। হযরত মোহাম্মদ (সা.) যখন মধ্যরাতে বাকিউল গারকাদের কবরস্থানে যান, তখন হিবাও সেখানে গিয়েছিলেন। হিবা বলেন,হযরত মোহাম্মদ (সা.) আমাকে দেখে বললেন, ‘আমাকে দুটো বিকল্পের একটি পছন্দ করতে বলা হয়েছে—এই জগতের সব সম্পদের মালখানার চাবি ও দীর্ঘজীবন অথবা বেহেশত, আমার আল্লাহর দিদার এবং তাৎক্ষণিক বেহেশত।’ হিবা বলেন, ‘আমি বললাম, আপনি প্রথমটি পছন্দ করেন।’ তিনি বললেন, ‘আমি দ্বিতীয়টি পছন্দ করেছি।’ অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ (সা.) মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে আল্লাহর দিদার লাভকে বেছে নিয়েছেন। আর এরই পরিপেক্ষিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে ওই অসুখে তার জীবনাবসান হবে, তা তার অজানা ছিল না।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কী অসুখ হয়েছিল, তা নিয়ে দুটি বিবরণ পাওয়া যায়। ইবনে ইসহাক তার সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থে দাবি করেন, হযরত মোহাম্মদ (সা.) বাকিউল গারকাদের কবরস্থান থেকে ফিরে প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হন। অন্যদিকে সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গ্রন্থের ব্যাখ্যাকার ইবনে হিশাম তার সিরাতুন নবী (সা.) গ্রন্থে বলেন,হযরত মোহাম্মদ (সা.) তার অন্তিম যাত্রায় প্রচণ্ড মাথাব্যথায় আক্রান্ত হন। মূলত হযরত মোহাম্মদ (সা.) প্রচণ্ড শিরপীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে অসহ্য মাথাব্যথা অনুভব করেন। ওই মাথাব্যথা এতটা মারাত্মক ছিল, তিনি তার অন্তিমযাত্রার অধিকাংশ সময় অজ্ঞান ছিলেন। একটু সুস্থ হলেও আবার জ্ঞান হারাতেন।
আবিসিনিয়া থেকে আনা ওষুধ খাওয়ানো হলেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিছুক্ষণ ভালো থাকলেও পরমুহূর্তে তিনি জ্ঞান হারাতেন। এ অবস্থায় হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারের সদস্য ও সাহাবীরা তার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দেন। ওই নিরাশার মধ্যেই একদিন হযরত মোহাম্মদ (সা.) আশার আলো জ্বালালেন। তিনি এক সকালে জ্ঞান ফিরে পেলেন। অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। সাত কুয়োর পানি দিয়ে গোসল করেন। নবী কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) এবং দুই নাতি হাসান (রা.) ও হোসেনকে (রা.) সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খান।হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর ওই সুস্থ হওয়ার ঘটনায় তার পরিবারের সদস্য ও সাহাবীরা আনন্দে আত্মহারা হন। খুশিতে তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নফল নামাজ আদায় করেন। আল্লাহর নামে গরিব-দুঃখীর মাঝে সামর্থ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করেন। হযরত আবু বকর (রা.) পাঁচ হাজার, হযরত উমর (রা.) সাত হাজার, হযরত আলী (রা.) তিন হাজার দিরহাম এবং হযরত আবদুর রহমান বিন আউফ একশত উট দান করেন।
নবিপত্নী হযরত আয়েশা (রা.)-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, সফর মাসের শেষ বুধবার হযরত মোহাম্মদ (সা.) হঠাৎ সুস্থ হয়ে ওঠেন। যদিও দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে নামতে হযরত মোহাম্মদ (সা.) আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওই ঘটনাকে আজও মুসলিমরা প্রতিবছর স্মরণ করেন। সফর মাসের শেষ বুধবার ওই ঘটনা ঘটে বলে এর নামকরণ হয় আখেরি চাহার শোম্বা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন