সিয়েরালিওন
সিয়েরালিওন পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ।
সিয়েরা লিওনের সাংবিধানিক নাম সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র। সিয়েরালিওনের উত্তর
সীমান্তে গিনি, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে লাইবেরিয়া এবং
দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের দিকে আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত। সিয়েরা লিওনের বৃক্ষহীন
তৃণভূমি অঞ্চল থেকে রেইনফরেস্ট পর্যন্ত একটি বিচিত্র পরিবেশের গ্রীষ্মমন্ডলীয়
জলবায়ু বিদ্যমান। সিয়েরা লিওন জাতিসংঘ,
আফ্রিকান
ইউনিয়ন, ওআইসি,
কমনওয়েলথ
সহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য রাষ্ট্র।
রাজধানী ফ্রিটাউন সর্ব বৃহত্তম শহর
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র।
আয়তন : ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার।
জনসংখ্যা : ৭০ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪১।
জাতিগোষ্ঠী : টেমনে ৩৫ শতাংশ, মেন্ডে ৩১ শতাংশ, ফুলানি ১২ শতাংশ, লিম্বা ৮ শতাংশ। সিয়েরা লিওনে প্রায় ১৬টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা ভাষা ও রীতিনীতি। দুটি বৃহত্তম ও সবচেয়ে
প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী হল টেমনে ও মেন্ডে ।টেমনে জাতিগোষ্ঠীকে দেশের উত্তরাঞ্চলে
প্রাধান্য করতে দেখা যায়, যখন মেন্ডেরা দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে তাদের
কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে।
ধর্মঃ সিয়েরা লিওন একটি নামমাত্র মুসলিম
দেশ। যদিও খ্রিস্টান সংখ্যালঘুরা যথেষ্ট প্রভাবশালী। সাধারণভাবে দেশের মোট
জনসংখ্যার ৬০% মুসলিম, ৩০% আদিবাসী বিশ্বাসী এবং ১০% খ্রিস্টান
ধর্মীয়। যাহোক, সেখানে আদিবাসী বিশ্বাসের সংগঠিত ধর্মীয়
সামঞ্জস্যতা অধিক। সিয়েরা লিওনকে বিশ্বের সবচেয়ে ধর্মীয় সহিষঞ্চু জাতি হিসাবে
গন্য করা হয়। মুসলিম ও খ্রিস্টানরা একে অপরের প্রতি সহযোগী
ও শান্তিপূর্ণ আচরণ করে। সিয়েরা লিওনে ধর্মীয় সহিংসতা খুবই বিরল।
ভাষাঃ দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সরকারি
প্রশাসন ও বিদ্যালয়সমূহে ইংরেজিতে কথা বলা হয়,
তবুও দেশে
এবং দেশের সকল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিও ভাষা সবচেয়ে বেশি কথ্য ভাষা।
বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য এবং একে অপরের সাথে সামাজিক
যোগাযোগে ক্রিও ভাষা ব্যবহার করে। তাছাড়া সিয়েরা লিওন ২০০২ সালে বাংলা ভাষাকে
সেখানকার সম্মানসূচক সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়।
মুদ্রা : লিওন।
জাতিসংঘে যোগদান : ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬১।
ইতিহাস
দীর্ঘদিন এখানে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৭৮৭
খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের ফ্রিটাউনেবসতি স্থাপন করে এর মূল
উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেসকল নিগ্রো ক্রীতদাস বৃটেনের
পক্ষে লড়াই করেছিল তাদের পুনর্বাসন। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফ্রিটাউনে মুক্ত
প্রাক্তন দাসের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০০ জন। ১৮০৮সালে ব্রিটিশ সরকার
সরাসরিফ্রিটাউনের প্রশাসনিক দায়িত্ব স্বহস্তে তুলে নেয়।এভাবে ফ্রিটাউন একটি
ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসাবে গড়ে ওঠে। ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল সিয়েরা লিওন একটি
সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ হিসেবে স্বাধীনতা অর্জন করে।১৯৬৪ সালে
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর দুর্নীতি,
অপশাসন ও
অযোগ্যতার কারণে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এর
ফলে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ (১৯৯১ - ২০০২) এক
দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে ধংসযজ্ঞ চলে। এ যুদ্ধে ৫০,০০০ বেশি মানুষ মারা যায়, দেশের
অবকাঠামো প্রায় ধংস করে এবং ২ লক্ষ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরনার্থী হিসাবে
বাস্তুহারা হয়।গৃহযুদ্ধের ফলে সংঘটিত হয় গণহত্যা,
ধর্ষণ ও
লুন্ঠন। ফলে সিয়েরা লিওনের রাজনৈতিক পরিবেশ চরমভাবে অশান্ত হয়ে উঠে। পশ্চিম
আফ্রিকার দেশগুলো সিয়েরা লিওনের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলেও শেষে
তা ব্যর্থ হয়। গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধ থামাতে জাতিসংঘ মিশনে বাংলাদেশি
শান্তিরক্ষীরা সেখানে যায়। দেশটিতে শান্তি-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নে বাংলাদেশি সৈন্যরা বড়
ভূমিকা পালন করে। ১৯৯৬ সালে সরকার ও বিদ্রোহী সংগঠনের মধ্যে শান্তিচুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ১৯৯৭ সালে বিদ্রোহী সংগঠন শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করলে আবার
শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। নির্বাচিত সরকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিরসনের জন্য বিদেশি শক্তির
হস্তক্ষেপ কামনা করে, যা সহিংসতাকে আড়ো বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের
সবচেয়ে ধর্মীয় সহিষ্ণু জাতি হিসাবে সিয়েরা লিওন এর ব্যপক সুনাম রয়েছে। সিয়েরা
লিওনে সকল ধর্মের মানুষেরাই একে অপরের প্রতি সহযোগী ও শান্তিপূর্ণ আচরণ করে। তাই
সিয়েরা লিওনে ধর্মীয় সহিংসতা কখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নি। কিন্তু সিয়েরা
লিওনের মানুষদের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গৃহযুদ্ধ।
প্রশাসনিক অঞ্চল
সিয়েরা লিওন উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চল চারটি ভৌগলিক অঞ্চলে
বিভক্ত। সিয়েরা লিওনে মোট চারটি প্রদেশ রয়েছে,
এগুলো হল-
উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ, দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ, পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ।যেগুলো আবার ১৪টি জেলায়
বিভক্ত।
এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশকে দুটি
জেলায় এবং বাকি প্রদেশগুলোকে ১২ টি জেলায় ভাগ করে মোট ১৪ টি জেলা নিয়ে
প্রশাসনিক অঞ্চল নির্ধারণ করা হয়েছে ।
অর্থনীতি
১৯৯০ সালের পর থেকে সিয়েরা লিওনের
অর্থনীতি পড়তির দিকে চলতে থাকে । বিশেষ করে ১৯৯০ এর পর থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চলা
গৃহযুদ্ধে এর অর্থনৈতিক অবকাঠামো সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পড়ে । গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার
পর থেকে সিয়েরা লিওনের ভঙ্গুর অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে । কিন্তু এসব
কিছুই নির্ভর করছে সরকারের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ নীতির উপরে, কেননা অনেকেই ধারণা করেন যে এই গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে সরকারের
দুর্নীতি অনেক বড় একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল ।জাতীয় ব্যাংকের নাম ব্যাংক অফ
সিয়েরা লিওন । সিয়েরা লিওন একটি কৃষি ভিত্তিক দেশ । দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৫৮
শতাংশ আসে কৃষি থেকে । দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি কাজ করে জীবিকা
নির্বাহ করে । প্রধান শস্য পণ্য হল ধান,
প্রায় ৮৫
শতাংশ কৃষক ধান চাষ করেন । দেশে বছরে জনপ্রতি ৭৬ কেজি ধান খাওয়ার জন্য ব্যবহার
করা হয়।
খনিজ সম্পদ
সিয়েরা লিওনকে বলা হয় ‘হীরার খনির গরিব
দেশ’। অসংখ্য খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ হলেও এ দেশের মানুষ
খুবই দরিদ্র ও অসুখী।সিয়েরা লিওন খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে হীরা, এটি অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। এছাড়াও
রয়েছে অন্যতম পণ্য টাইটানিয়াম ও বক্সাইট,
অন্যতম
প্রধান পণ্য সোনা, এবং রয়েছে রুটাইল এর পৃথিবীর বৃহত্তম
মজুদের একটি অংশ। সিয়েরা লিওনে রয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক হারবর।
এত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও সিয়েরা লিওনের ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমায়
বসবাস করে।
সিয়েরালিওনে অফিসিয়াল ভাষা বাংলা
বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার
দূরের আফ্রিকান দেশ সিয়েরা লিওন । সেখানে ২০০২ সালে অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে বাংলাকে
সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয় । পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ সিয়েরা লিওনে অফিসিয়াল ভাষা
হিসাবে বাংলা ভাষার নাম ঘোষণা করা হয়। ভৌগলিক বা সাংস্কৃতি উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ
থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সিয়েরা লিওন। কিন্তু এ দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই গভীর ও
আন্তরিক যে, এ দেশের ভাষাকে নিজেদের করে নিয়েছে
আফ্রিকার দেশটি। ১৯৯১-২০০২ সাল পর্যন্ত দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে গৃহযুদ্ধে অভিশাপে।
সেই সময়টাতে সিয়েরা লিওনে শান্তি ফেরাতে বিপুল পরিমাণ শান্তি বাহিনী নিয়োগ করে
জাতিসংঘ। তাদের বড় একটি অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ দেশের
সেনারা সিয়েরা লিওনের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দেশটিতে শান্তি ফেরাতে
রেখেছেন ব্যাপক ভূমিকা। বিদ্রোহীদের দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের
সেনা সদস্যদের কার্যক্রম ছিল অনবদ্য। বাংলাদেশিরা যা করেছেন, তার জন্য সিয়েরা লিওনের সরকার কৃতজ্ঞ। ২০০২ এর আগে পরে শান্তি ফিরে আসে
দেশটিতে। প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ কৃতজ্ঞতা জানাতে একটুও দেরি করেনি
।বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের ভূমিকাকে চিরস্মারণীয় রাখতে তিনি বাংলা ভাষাকে দেশটির
সরকারি ভাষার মর্যাদা দিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন