বাড়তি মোহরানা বিলম্বিত বিবাহ ও বিবাহ ঋণ




মো. আবু রায়হান
বর্তমান সময়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কে কার চেয়ে বেশি মোহরানা দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করবে- এ নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে কনেপক্ষ। বরের সামর্থ্য বিবেচনা না করে বরের ওপর অযৌক্তিকভাবে ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের চিকিৎসক দম্পতি আকাশ-মিতুর নির্মম বিচ্ছেদের জন্য দেনমোহরকে প্রধান উপজীব্য বলে মনে হয়। বেচারা আকাশ ৩৫ লাখ টাকা দেনমোহর দিয়ে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে আত্মঘাতি হতে বাধ্য হন। ইদানীং অভিযোগ উঠেছে, একশ্রেণির নারী বিয়ের দেনমোহরকে ব্যবসায়ে পরিণত করেছে। বিয়ের কিছুদিন পর পরকীয়া কিংবা তুচ্ছ অজুহাতে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে। এতে করে দেনমোহরের পুরো টাকা বরকে বহন করতে হয়।অনেকেই মনে করেন, দেনমোহরের টাকা স্ত্রীকে দিতে হয় শুধু বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটলে। এটা অজ্ঞতা ও চরম ভুল ধারণা। বিয়েবিচ্ছেদ না হলেও দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করা আবশ্যক।
মহর শব্দটি আরবি, এর বাংলা উচ্চারণ মাহর, মুহর, মোহর। মহর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দান-অনুদান। সোনার তৈরি মুদ্রাবিশেষ বা স্বর্ণমুদ্রাকেও মহর বলা হয়। নামের সিল বা ছাপও মহর নামে পরিচিত। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় বিয়ের সময় বরের পক্ষ থেকে কনেকে যে অর্থ বা সম্পদ দেওয়া হয়, তাকে মহর বলে।শরহে বেকায়া গ্রন্থের প্রান্তটিকায় বলা হয়েছে-বিবাহবন্ধন উপলক্ষে স্বামী বাধ্যতামূলকভাবে স্ত্রীকে নগদ অর্থ, সোনা-রুপা বা স্থাবর সম্পত্তির আকারে যে মাল প্রদান করে সেই মালকে মোহর বলে।
Mahr is a sign of responsibility of the husband and is a must to pay the bride with currency, movable or immovable properties.
মোহরের মূল উদ্দেশ্যই হল নারীকে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া। এটা নারীর মূল্য নয় যে, তা পরিশোধ করলেই মনে করা যাবে যে, নারী নিজেকে স্বামীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।ইসলামি শরিয়তের উদ্দেশ্য হল- যখন কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ঘরে আনবে তখন তাকে মর্যাদার সঙ্গে আনবে এবং এমন কিছু উপহার দেবে, যা তাকে সম্মানিত করে।The purpose of the Mahr is to provide the wife with independent financial security, whereby this amount becomes her exclusive property.
ইসলামে দেনমোহর নারীর অধিকার, যা অবশ্যই স্ত্রীকে প্রদান করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘তোমরা খুশিমনে স্ত্রীকে মোহর পরিশোধ কর।’ (সুরা আন নিসা : ৪)। তাই অন্যসব অধিকারের মতো স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করা স্ত্রীর অধিকার রয়েছে। দেনমোহর নির্ধারণ হয় স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের আলোচনাসাপেক্ষে। মহরের পরিমাণ এত কম হওয়া উচিত নয়, যাতে মেয়ের সম্মান ও অধিকার ক্ষুণ্ন হয় এবং এত বেশি হওয়াও বাঞ্ছিত নয়, যা ছেলের ওপর জুলুম হয়। মহর পরিশোধের উদ্দেশ্যেই নির্ধারণ করতে হবে, শুধু নামের জন্য নয়।
এর সর্বনিম্ন পরিমাণ ইসলামে নির্ধারিত আছে; সর্বোচ্চ পরিমাণের কোনো সীমা নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের খুশিমনে মোহর দিয়ে দাও, তারা যদি খুশি হয়ে তা থেকে অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ (সুরা আন নিসা : ৪) হাদিসে পাকে দেনমোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারিত রয়েছে। সর্বনিম্ন দেনমোহর হলো ১০ দিরহাম বা ৩০.৬১৮ রূপার সমপরিমাণ মূল্য। হাদিসে এসেছে-‘১০ (দশ) দিরহামের কম মোহর হতে পারে না।’ (বায়হাকি)অনেক ইসলামি পন্ডিতদের মতে, যদি ১০ দিরহামের কমে কোনো নারী দেনমোহর নির্ধারণে রাজি হয় তবে এ দেনমোহর ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ হবে না। মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণে ইমামদের মতভেদ -
ক. ইমাম শাফেয়ী (র) ও ইমাম আহমদের (র) মতে মোহরের কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই, বরং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যে বস্তুতে একমত হয়, তা কম হোক কিংবা বেশি হোক— সেটাই মোহর হিসেবে নির্ধারণ করা। ইমাম শাফেয়ী আরও বলেন, বিবাহ ক্রয়-বিক্রয়ের ন্যায়। ক্রয়-বিক্রয়ের যেমন মূল্যের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নেই, বিবাহের ক্ষেত্রেও মোহরের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিমাণ নেই।
খ. ইমাম মালিক (র) বলেন, মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ তিন দিরহাম।
গ. হযরত ইব্রাহিম নাখয়ীর (র) মতে, মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ এক দিরহাম।
ঘ. সাঈদ ইবনে জুবায়েরের (রা.) মতে, ৫০ দিরহাম।
ঙ. ইমাম আযম আবু হানিফার (র) মতে মোহরের সর্বোচ্চ কোনো পরিমাণ শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত হয়নি। তবে মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ হলো ১০ দিরহাম, যা বাংলাদেশী টাকায় ৫ শত ৫০ টাকা।
মোহর কম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে স্বেচ্ছায় বেশি দেয়া নিন্দনীয় নয়।মহানবী সা: তাঁর কোনো স্ত্রী ও কন্যার মোহর ৪৮০ দিরহাম (এক হাজার ৪২৮ গ্রাম ওজনের রৌপ্যমুদ্রা) এর অধিক ছিল না। হজরত আয়েশা বলেন, তাঁর মোহর ছিল ৫০০ দিরহাম (এক হাজার ৪৮৭, ৫ গ্রাম ওজনের রৌপ্যমুদ্রা)। তবে কেবল উম্মে হাবিবার মোহর ছিল চার হাজার দিরহাম (১১ হাজার ৯০০ গ্রাম রৌপ্যমুদ্রা)। অবশ্য এই মোহর বাদশাহ নাজাশী মহানবী (সা:)এর তরফ থেকে আদায় করেছিলেন।
হযরত ফাতেমা (রা.)-এর মোহর ছিল একটি লৌহবর্ম। বরকতপূর্ণ বিবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে উম্মাহাতুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সবচেয়ে বরকতময় বিয়ে হচ্ছে সুন্নতি বিয়ে; অর্থাৎ যে বিয়েতে খরচ কম হয় এবং কোনো জাঁকজমক থাকে না।’ (মিশকাত শরিফ) সুতরাং মোহর হবে বরের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী। রাসূল (সা.) এক হাদিসে শরিয়তের মূলনীতিরূপে বলেছেন, ‘সাবধান, জুলুম করো না। মনে রেখো, কারও পক্ষে অন্যের সম্পদ তার আন্তরিক তুষ্টি ব্যতীত গ্রহণ করা হালাল হবে না। (মিশকাত/২৪৫)।
মোহর কত হওয়া উচিত ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত অধিকার হলো- ‘মোহরে মিছাল’। তাহলো- ওই নারীর বংশে তার মতো অন্যান্য নারীদের সাধারণত যে মোহর নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা তার মোহরে মিছাল। যদি তার নিজের বংশে তার মতো আর কোনো নারী না থাকে, তবে অন্য বংশে তার সমপর্যায়ের নারীদের যে মোহর সাধারণত নির্ধারণ করা হয়; সেটাই তার মোহরে মিছল। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে স্ত্রী মূলত মোহরে মিছালেরই হকদার।
দেনমোহর দুই প্রকার। একটি তাৎক্ষণিক দেনমোহর, যা স্ত্রীর চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী তাৎক্ষণিক দেনমোহর না পাওয়া পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন শুরু করতে অস্বীকার করতে পারেন।
আরেকটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর। বিলম্বিত দেনমোহর বিবাহবিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া স্বামী সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে স্ত্রীকে বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।
মহর নগদে প্রদান করা উচিত। উভয় পক্ষের সম্মতিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ বাকিও থাকতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য।মহরের অর্থ একান্তই স্ত্রীর। এই অর্থ তিনি যেভাবে খুশি ব্যয় করতে বা সঞ্চয় রাখতে পারবেন অথবা বিনিয়োগ করবেন। তিনি যাকে ইচ্ছা দান-অনুদান বা উপহার ও হাদিয়া হিসেবে দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা অন্য কারও কিছু বলার থাকবে না।
কোরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, দেনমোহর পুরুষের ওপর স্ত্রীর ঋন এবং এটা আদায় করা ওয়াজিব। অতএব তা আদায় না করলে স্বামী গোনাহগার হবেন এবং স্ত্রীর নিকট এই ঋণ অবশিষ্ট থেকে যাবে। তবে হ্যাঁ, যদি স্ত্রী স্বেচ্ছায় মোহরের দাবী ছেড়ে দেয়, তবে স্বামীর ওপর এর বাধ্যকতা অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু স্ত্রীকে মোহর ক্ষমা করে দেওয়ার ব্যাপারে বাধ্য করা কিংবা মোহর আদায় করতে অস্বীকৃতি জানানো- অমার্জনীয় অপরাধ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রায় ২৬ লাখ বেকার রয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশ যুবক-যুবতী। যাদের বেশির ভাগ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। এসব তরুণ বেকারত্বের কারণে বৈবাহিক জীবনকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। বৈবাহিক জীবন মানুষের জীবনের অন্যতম অধ্যায় হলেও পুরোটাই নির্ভর করে স্বাবলম্বী হওয়ার ওপর। বেকারত্বের কারণে প্রাপ্তবয়স্ক তরুণরা পিছিয়ে যাচ্ছে বৈবাহিক জীবন থেকে। পা বাড়াচ্ছে হতাশার জগতে। তৈরি করছে অপরাধজগৎ। এভাবে চলতে থাকলে হতাশা থেকে তৈরি হবে বিকৃত মানসিকতার শিক্ষিত তরুণসমাজ। সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে সমাজের।
বিবাহের জন্য জন্য ঋণ দিচ্ছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। তবে বেকাররা এই ঋণের উপযুক্ত না।আপনি যেকোন প্রতিষ্ঠানে সরকারি বা বেসরকারি যদি চাকরি করেন এবং আপনার বেতন সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা হয় তবে আপনি বিবাহ ঋণ পাবেন। বিয়ে-সংক্রান্ত প্রয়োজন মিটাতে দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক ‘বিয়ে ঋণ’ চালু করেছে। তা হলো- প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, আইএফআইসি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, ইচএসবিসি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল