সেনেগাল

 


মো.আবু রায়হানঃপশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগাল। সেনেগালের পশ্চিমে আটলান্তিক মহাসাগর; উত্তরে মৌরিতানিয়া,পূর্বে মালি এবং দক্ষিণে গিনি ও গিনি-বিসাও। দক্ষিণ সীমানা সেনেগালের সঙ্গে সংযুক্ত। এ ছাড়া গাম্বিয়ার সঙ্গে জলসীমান্ত রয়েছে সেনেগালের। সেনেগাল-এর নামকরণ সেনেগাল নদী থেকে। সেনেগালের পূর্ব ও উত্তরের সীমান্তে এর অবস্থান। এর আদি উচ্চারণ ছিল সুনু গাল যার অর্থ আমাদের নৌকা। জানা যায়, ১৫ কিংবা ১৬ শতকের দিকে পর্তুগিজরা সেনেগালে আসে। স্বাভাবিক ভাবেই তখন দেশটির নাম তাঁদের জানা ছিল না। তখন স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কাছে নাম জানতে চাইলে তাঁরা বলে ‘সুনু গাল’। কিন্তু পর্তুগিজরা ওই শব্দের কোনও অর্থ বুঝতে না পেরে নাম দিয়ে ফেলে সেনেগাল। তবে সাধারণ মানুষের মতে সেনেগাল নদীর ওপর ভিত্তি করে দেশটির নাম রাখা হয়েছে সেনেগাল।

রাজধানীঃ ডাকার।

আয়তনঃ এক লক্ষ ৯৬ হাজার ৭২২ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে ৮৬তম দেশ।

জনসংখ্যাঃ ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী, সেনেগালের জনসংখ্যা এক কোটি সাতান্ন লাখের কিছু বেশি।

ধর্মঃ শতকরা ৯৪ ভাগ মুসলমান, ৫ ভাগ খ্রিষ্টান এবং অবশিষ্ট এক ভাগ অন্যান্য ধর্মের। মুসলিমরা শুধু নামেই মুসলিম নয়; তারা যথেষ্ট ধার্মিক। ধর্মচর্চায় সেনেগালবাসীর বেশ সুনাম রয়েছে। মুসলমান ছাড়াও ৫ ভাগ খ্রিষ্টান এবং অবশিষ্ট এক ভাগ অন্যান্য ধর্মের।

ফরাসি ভাষা সেনেগালের সরকারি ভাষা। প্রায় ৩৫ শতাংশ লোকের মাতৃভাষা হল ওলোফ ভাষা। আরও প্রায় ৪৫ শতাংশ লোক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ওলোফ ভাষাতে কথা বলতে পারেন। সেনেগালে আরও প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে দিওলা ভাষা, ফুলাকুন্দা ভাষা, মালিংকে ভাষা, সেরের ভাষা এবং সোনিংকে ভাষা উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক কাজকর্মে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয়।

সেনেগালের মুদ্রার নাম কমুটেট ফাইনেনসিয়ার আফ্রিকানি ফ্রান্সি, সংক্ষেপে যা জফ হিসেবে প্রচলিত।

নামকরণ

এক মতবাদ অনুযায়ী জানা যায়, ১৫ কিংবা ১৬ শতকের দিকে পর্তুগিজরা সেনেগালে আসে। স্বাভাবিক ভাবেই তখন দেশটির নাম তাঁদের জানা ছিল না। তখন স্থানীয় মৎস্যজীবীদের কাছে নাম জানতে চাইলে তাঁরা বলে ‘সুনু গাল’। কিন্তু পর্তুগিজরা ওই শব্দের কোনও অর্থ বুঝতে না পেরে নাম দিয়ে ফেলে ‘সেনেগাল’। তবে সাধারণ মানুষের মতে সেনেগাল নদীর ওপর ভিত্তি করে দেশটির নাম রাখা হয়েছে ‘সেনেগাল’।

ইতিহাস

প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে সেনেগালে ইসলামিক উপস্থিতি রয়েছে। নবম শতাব্দীতেবিভিন্ন উপজাতি তে বিভক্ত সেনেগালঅঞ্চলের সাথে ইসলামের যোগাযোগ শুরু হয়।তখন হতে ট্রান্স সাহারা বাণিজ্যপথ দিয়ে বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে ইসলাম প্রচারক দল এ অঞ্চলে আসতে থাকে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে সেনেগালে আব্দুল্লাহ বিন ইয়াসিনের নেতৃত্বে ব্যাপক ইসলাম প্রচার শুরু হয়।উল্লেখ্য যে এই উদ্দীপনাময় প্রচারকরা পশ্চিম আফ্রিকায়সেনেগাল হতে গ্যাবন পর্যন্ত এঅঞ্চলে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের কৃতিত্বের অধিকারী।মরক্কোতে মুরাবিতরা ( ১০৯০-১১৪৭)একটি শক্তিশালী শাসন কায়েম করে।

মুরাবিতদেরপর এঅঞ্চল মালি সাম্রাজ্যভুক্ত (১২৩৫-১৬৭০)হয়।এরপর শুরু হয় খণ্ড-খণ্ড দুর্বল শাসনব্যবস্থা।১৫ কিংবা ১৬ শতকের দিকে পর্তুগিজরা সেনেগালে আসে। পর্তুগিজরা আসার আগে সেনেগাল বেশ কয়েকটি সম্রাজ্য ও রাজ্যের অধীনে ছিল।

তিনশত বছর ফরাসি উপনিবেশ হিসাবে শাসিত হওয়ার পর ১৯৫৮ সালে সেনেগাল ফরাসি কমিউনিটির সদস্য হিসেবে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করে। .১৯৫৯ সালের মে মাসে সেনেগাল ও মালিক একত্রেমালি ফেডারেশন গঠন করে।কিন্তু ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরেই ফেডারেশন ভেঙে যায় এবংসেনেগাল প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষিত হয়। তখন স্বাধীন দেশের প্রধান রাষ্ট্রপতি হন লিওপোল্ড ফেডার সিংহল, যিনি একজন কবি এবং দার্শনিক ছিলেন। তিনি নিজেই সেনেগালের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেন।স্বাধীনতা-উত্তরসেনেগালের সর্বত্র ফরাসি প্রভাব দেখা যায়। সেনেগালে ফরাসিদের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে ।।

স্বাধীনতা দিবস ও কুরআন খতম

৪ এপ্রিল সেনেগালের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স থেকে তারা স্বাধীনতা লাভ করে। সেনেগালের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অনুষ্ঠান আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো হলেও আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেটা হলো, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণে আয়োজিত সমাবেশে দাঁড়িয়ে পবিত্র কোরআন খতম দেওয়া হয়।অনুষ্ঠানে উপস্থিত কোরআন তেলাওয়াতে আগ্রহীদের আগে থেকেই এক পৃষ্ঠা করে ভাগ করে দেওয়া হয়। সেনেগালের প্রচলিত কোরআন শরিফগুলো ৩০০ পাতার (৬০০ পৃষ্ঠা)। সে হিসেবে কোরআন খতম দিতে প্রয়োজন হয় ৬শ’ মানুষের মাত্র ২ থেকে ৩ মিনিট। মানুষ বেশি হলে একাধিক খতম দেওয়া হয়। কোনো দেশের স্বাধীনতা দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় এটি একটি নতুন মাত্রা।

বাংলাদেশ–সেনেগাল সম্পর্ক

বাংলাদেশ থেকে সেনেগালের সময়ের ব্যবধান ৫ ঘন্টার। বাংলাদেশ–সেনেগাল সম্পর্ক হল বাংলাদেশ এবং সেনেগাল রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম আফ্রিকানরাষ্ট্র হল সেনেগাল। রাজধানী ডাকারে বাংলাদেশের দূতাবাস থাকলেও বাংলাদেশে সেনেগালের কোনো নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত নেই। দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক উষ্ণ এবং উভয়েই এ সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করে তুলবার ব্যাপারে একমত।

২০০৩ সালে সেনেগাল অর্গানাইজেশন অব ইসলামি কোঅপারেশনে বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেলকে সমর্থন দেয়।

অর্থনীতিঃ

সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করা এখানকার মানুষের অন্যতম প্রধান পেশা। এরা নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ ধরে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাছাড়া দেশটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আম উৎপাদন হয়। চাষ হয় প্রচুর ক্যাসোনাট। কৃষির জন্য প্রচুর জমি পড়ে থাকলেও কৃষিকাজের জন্য তেমন আগ্রহ নেই তাঁদের। সেনেগালের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে—খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, খনি, সিমেন্ট, কৃত্রিম সার, রাসায়নিক, টেক্সটাইল, পেট্রোলিয়াম পণ্যের পরিশোধন ও পর্যটন। তারা মাছ, রাসায়নিক, তুলা, কাপড়, বাদাম ও ক্যালসিয়াম ফসফেট রপ্তানি করে। বিদেশে তাদের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। এ ছাড়া তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও যুক্তরাজ্যেও পণ্য রপ্তানি করে।

বিশ্বকাপ ফুটবল 

ফুটবলে জায়ান্ট কিলার হিসেবে বেশ খ্যাতিমান পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সেনেগাল। সাদিও মানের দেশ সেনেগালের এটা তৃতীয় বিশ্বকাপ ফুটবল। তারা প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল খেলে ২০০২ সালে। প্রথমবারেই শেষ ষোলোয় পৌঁছে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। 


সাদিও মানে
সাদিও মানেকে সেনেগালের বিশ্বকাপ দলে রাখা হলেও জানানো হয়েছিল, নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটি খেলতে পারবেন না। কিন্তু শঙ্কাটা ছিলই, তিনিই আদৌ বাকি ম্যাচগুলোতে মাঠে নামতে পারবেন কি না! শেষ পর্যন্ত শঙ্কাই সত্যি হলো, বিশ্বকাপকেই বিদায় বলতে হচ্ছে বায়ার্ন মিউনিখ তারকার।
আফ্রিকা অঞ্চলের দুইবারের বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব জেতা সাদিও মানেকে এবারের বিশ্বকাপে দর্শক হয়েই থাকতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত হাঁটুর চোট ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ থেকে পুরোপুরি ছিটকে দিল মানেকে। মানেকে ছাড়াই সোমবার (২১ নভেম্বর) নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবে। চোট আক্রান্ত হওয়ার পরেও তারকা ফুটবলার সাদিও মানেকে নিয়েই বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করেছিল সেনগাল। মানেকে বিশ্বকাপে পাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল তারা। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। চোট গুরুতর হওয়ায় অস্ত্রপাচার করতে হবে সাদিও মানের। আর তাই এবারের বিশ্বকাপ খেলছেন না তিনি।
১৯৯২ সালে সেনেগালে জন্ম নেওয়া সাদিও মানের ছোটবেলাটা খুব মধুর ছিল না। বেড়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ সেনেগালের বাম্বালি নামের একটি গ্রামে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা একদমই ভালো ছিল না।
“আমাকে স্কুলে পাঠানোর মতো অর্থ আমার পরিবারের কখনোই ছিল না“, এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন মানে। অনেকগুলো ভাইবোন থাকায় তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার চাচার কাছে। শৈশবের বড় অংশটি চাচার কাছেই কেটেছে।
খুব ছোট থেকেই ফুটবলের নেশা পেয়ে বসে মানেকে। তিন বছর বয়সী ‘পিচ্চি’ মানের শরীরে সবসময় কাপড় না থাকলেও পায়ে ফুটবল থাকত। রাস্তায় সমবয়সীদের দেখলেই মানেকে আর আটকে রাখা যেত না, বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেন খেলার উদ্দেশ্যে।

ফুটবলের প্রতি মানের প্রভূত আকর্ষণ থাকলেও প্রথমদিকে পরিবারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য পাননি। তার ভাষ্যমতে,
‘বিশ্বকাপের পরে আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে গ্রামে ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করলাম। আমি প্রতিটা ম্যাচ জিততে চাইতাম। সবাই আমার প্রশংসা করত, কিন্তু আমার পরিবার আসলে তেমন ফুটবল-সহায়ক ছিল না। তারা আমার জন্য অন্য কিছু পছন্দ করে রেখেছিল, কিন্তু আমার হৃদয়ে ছিল শুধু ফুটবল।’
পরিবার চেয়েছিল, মানে ধর্মের সাথে সম্পর্কিত কোনো পেশায় নিয়োজিত হোক। মানের বাবা ছিলেন একটি স্থানীয় মসজিদের ইমাম। কিন্তু ফুটবল থেকে মানেকে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না দেখে পরিবার তার স্বপ্নপূরণে সর্বোচ্চ সহযোগিতার সিদ্ধান্ত নেয়।
সেনেগালের রাজধানী ডাকারে নিয়ে গিয়ে ‘জেনারেশন ফুট’ নামের এক ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করানো হয় মানেকে। জেনারেশন ফুটে ভর্তির ট্রায়ালের সময় শুরুতেই বুড়ো কোচ তার পুরনো বুট, ছেড়া শর্টস্ নিয়ে খোঁচা দিয়েছিল। খোঁচার বিপরীতে মানের সোজাসাপ্টা জবাব, “এসব নিয়ে খোঁচা দিয়ে লাভ নেই, আমি মাঠেই দেখাব আমি কে।” ট্রায়ালের সময় খোঁচা দেয়া সেই বুড়ো কোচ ট্রায়ালের পর মানের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ হন যে, সেদিনই তাকে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করে নেন।
মানে অবশ্য তার পরিবার, তার চাচা, গ্রামের মানুষজন এমনকি রাজধানী ডাকারে গিয়ে যে পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সবার প্রতিই কৃতজ্ঞ। তার চাচার সেই সময়ের সহযোগিতাকে খুব বড় করে দেখেন মানে। তার যাবতীয় খরচ বহনের জন্য গ্রামের সবাই চাঁদা দিয়েছিল, তার চাচা ও পরিবার জমির ফসল বিক্রি করে পাওয়া অর্থের একটি বড় অংশ খরচ করেছিলেনন মানের স্বপ্নপূরণে। এসব কথা মানে অকপটেই বলেছেন। ডাকারে গিয়ে যে বাড়িতে ওঠেন, সে বাড়ির লোকজন তার একদমই পরিচিত ছিল না। কিন্তু মানের স্বপ্নের কথা শুনে তারা সাহায্য করতে রাজি হয়ে যান, তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
তিনি একজন অনুশীলনকারী মুসলমান এবং প্রতিটি ম্যাচ শুরুর পূর্বে তাকে দোয়া করতে দেখা যায়।

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল