ইসমাঈল হানিয়া ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর
মো.আবু রায়হান
ইসমাঈল আবদুস সালাম আহমেদ হানিয়া ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রাজনৈতিক শাখার নেতা।জন্ম ২৯ জানুয়ারি ১৯৬২ সাল।ইসমাইল হানিয়া মিশর অধিকৃত গাজা উপত্যকার আল-শাতি উদ্বাস্তু শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন।হানিয়ার বাবা মাছ ধরার পেশায় যুক্ত ছিলেন।১৯৪৮ আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় তার বাবা মা বর্তমান ইসরায়েলের অন্তর্গত আসকালানের নিকটস্থ বাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হন।ইসমাইল হানিয়া জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এরপর গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে স্নাতক হন।ছাত্রাবস্থায় মুসলিম ব্রাদারহুডের মতাদর্শ হানিয়াকে আকৃষ্ট করে।১৯৮৫-১৯৮৬ সালে হানিয়া মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি ছাত্র কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন।ইসলামিক এসোসিয়েশন ফুটবল দলে ইসমাইল হানিয়া মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেন। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদার প্রায় সমসাময়িক কালে তিনি স্নাতক হন। বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে ইসমাইল হানিয়া ইসরায়েলে স্বল্পকালীন কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি পুনরায় ইসরায়েল কর্তৃক গ্রেপ্তার হন এবং ছয় মাস কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৮৯ সালে ইসমাইল হানিয়া তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়ার পর আবদুল আজিজ আল-রানতিসি, মাহমুদ জাহহার ও আরো ৪০০ কর্মীর সাথে ইসরায়েল তাকে লেবানন পাঠিয়ে দেয়।তারা দক্ষিণ লেবাননের মার্জ আল-জহুরে এক বছর অবস্থান করেছিলেন। বিবিসির মতে এখানে হামাস যথেষ্ট পরিমাণে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। এক বছর পর ইসমাইল হানিয়া গাজায় ফিরে আসেন এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন নিযুক্ত হন।
ইসমাইল হানিয়া ও এরদোগান |
ইসমাঈল হানিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহর সাইয়েদ হাসান নাসরুল্লাহর বৈঠক |
২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের নির্বাচনে হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে পুঁজি করে নির্বাচনে আরাফাতের ফাতাহকে হারিয়ে দেয়। হানিয়ার হাত ধরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় হামাস। নির্বাচনে ১৩২ আসনের মধ্যে হামাস ৭৬টি এবং ফাতাহ ৪৩টি আসন পায়।হামাস নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে হানিয়া প্রধানমন্ত্রী হন।কিন্তু হামাস–ফাতাহের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে গাজায় উত্তেজনা বাড়ে। ডিসেম্বরে হানিয়ার ওপর হামলা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তিনি। হামাস দাবি করে, এই হামলায় ফাতাহ জড়িত। হামাসের সরকার গঠনের এক বছরের মাথায় ২০০৭ সালের জুনে মার্কিনদের, বিশেষ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম রূপকার কন্ডোলিৎসা রাইসের পরামর্শে হানিয়া সরকারকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।তার স্থলে ফাইয়াদ নিয়োগ পান। আইন পরিষদ এই নিয়োগকে অবৈধ বিবেচনা করে হানিয়ার স্বীকৃতি বজায় রাখে।সেসাথে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি তাকে বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গণ্য করতে থাকে।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীর ও হামাস গাজা উপত্যকা শাসন করে। কিন্তু ইসমাইল হানিয়া আদেশ মেনে নেননি এবং গাজায় প্রধানমন্ত্রীত্ব করতে থাকেন।গাজায় স্বঘোষিত সরকার চালাচ্ছেন হানিয়া। যদিও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর সরকারের স্বীকৃতি নেই। তাদের কাছে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সরকারই ফিলিস্তিনের বৈধ কর্তৃপক্ষ।
জেনারেল কাসেম সোলাইমানির জানাজা |
২০১৩ সালের এপ্রিলে হানিয়া হামাসের উপপ্রধান হন। সময়টা ২০১৬ সাল। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যেই ইসরায়েলের কট্টরপন্থী রাজনীতিক আভিগদর লিবারম্যান হুঁশিয়ারি দেন, ‘আমি যদি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হই, তাহলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে।’ এই হুঁশিয়ারির এক মাসের মাথায় লিবারম্যান সত্যি সত্যি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তবে হানিয়াকে হত্যার হুঁশিয়ারি বাস্তবায়ন করতে পারেননি।লিবারম্যানের হুঁশিয়ারির পরের বছর ইসমাইল হানিয়া ২০১৭ সালের ৬ মে হামাসের প্রধান হিসেবে খালেদ মেশেলের স্থলাভিষিক্ত হন। এই হামাস ফিলিস্তিনিদের চোখে স্বাধীনতাকামী সংগঠন আর পশ্চিমাদের কাছে সন্ত্রাসী সংগঠন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে হামাসের প্রধান হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ৫৯ বছর বয়সী ইসমাইল হানিয়া।আগামী চার বছর তিনি এ পদে থাকবেন। এর মধ্য দিয়ে হামাস ও ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও মজবুত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
২০১৮ সালে ইসমাইল হানিয়াকে বিশ্ব সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হামাসের সামরিক শাখার সঙ্গে হানিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও তিনি ইসরাইলের বেসামরিক লোকজনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তাবক।হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে।২০১৭ সালে হামাসের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রথম সফর করেন ইরান ।ওই সময় ইসরায়েল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই দখলদার ইহুদি সরকারকে স্বীকৃতি দেব না। জেরুজালেম মুক্ত করার আগপর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাব।’এছাড়া তিনি তুরস্ক, মিসর ও মালয়েশিয়া সফর করেন।মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানির জানাজায় অংশ নেন তিনি।সুলেইমানির দাফন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন হানিয়া। এ সময় তিনি সুলেইমানিকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে অভিহিত করেন। আল–কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে ‘আরব বিশ্বের পবিত্র যোদ্ধা’ মনে করতেন হানিয়া। ২০১১ সালে পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন সেনাদের গোপন অভিযানে নিহত হন লাদেন। এর প্রতিক্রিয়ায় হানিয়া বলেন, ‘আরব বিশ্বের পবিত্র একজন যোদ্ধাকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন