সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

২০ বছর আফগান যুদ্ধের পর তালেবানেরা কি হালাল হয়ে গেল ?


মো.আবু রায়হান
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতাসীন ছিল।পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তালিবানরা আফগান রাজধানী কাবুলে ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র তিনটি দেশ তাদেরকে স্বীকৃত দিয়েছিল: পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। মানবাধিকার লংঘনের জন্য আফগানিস্তান জাতিসংঘের স্বীকৃতি হারিয়েছিল এবং ইরান, ভারত, তুরস্ক, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশ তালেবান শাসনের বিরোধিতা করেছিল এবং তালিবান বিরোধী আফগান নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সাহায্য করেছিল।ঘটনার সূচনা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। তাসের ঘরের মতোই ধসে পড়েছিল আমেরিকার টুইন টাওয়ার। সব মিলিয়ে প্রাণ গিয়েছিল ৩ হাজার মানুষের। আহত হয়েছিলেন আরও ২৫ হাজার। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগনে কথিত আল-কায়দা হানার ঠিক পরেই 'ওয়ার এগেইনেস্ট টেরর' নামে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু বুশ। আফগানিস্তানের শান্তি ফেরাতে মূলত তালিবান-বিরোধী অভিযানেই সেনা নামিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আফগানিস্তানের নর্দার্ন আ্যালায়ান্স মিলিশিয়া গোষ্ঠী অভিযান চালিয়ে তালেবানদের ক্ষমতাচ্যুত করে। তারপর পেরিয়ে গেছে ২০ টা বছর।
এখন পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে। জখম হয়েছে ২০,০০০। সেই সাথে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্য মারা গেছে। আরো কয়েকটি দেশের কয়েকশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে দুই দশকের এই যুদ্ধে।
তবে এই যুদ্ধে বহুগুণ বেশি হতাহত হয়েছে আফগানরা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য মারা গেছে। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তার দ্বিগুণ।২০ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছে সেখানে। আর অর্থ-কড়ি ব্যয় হয়েছে পাহাড় সমান। এখন পর্যন্ত আফগান যুদ্ধের জন্য মার্কিন করদাতাদের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার যোগাতে হয়েছে।
তবে রক্তক্ষয় আর না, জানিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন। ঘোষণা করলেন, ৯/১১-র কুড়ি বছর পূর্তির আগেই আফগানিস্তান থেকে সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করে নেবে আমেরিকা। সেনা প্রত্যাহার করে ওয়াশিংটন। সেনা প্রত্যাহারের পর দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে তালেবানের। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে অধিকাংশ বিদেশি সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণার পর থেকে তালেবান দেশটির গ্রামীণ এলাকাগুলো দ্রুত দখল নিতে শুরু করে। অনেক জায়গায় সেনাদের সঙ্গে তালেবান যোদ্ধাদের তীব্র লড়াই চলছে। আফগানিস্তান ভূখণ্ডের ৮৫ শতাংশ দখল করে নিয়েছে বলে দাবি করেছে তালেবানরা।
তালেবানের সঙ্গে সাম্প্রতিক চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে। আফগান পরিস্থিতিতে নিজেদের জন্য সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দেখেছে চীন। তালেবান নেতা মোল্লা আব্দুলগনি বারাদারের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি তালেবান প্রতিনিধি বেইজিং সফর করে।দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছে তালেবান প্রতিনিধিদল।এ সম্পর্কে তালেবানের অন্যতম মুখপাত্র মোহাম্মদ নাঈম জানান, তাদের প্রতিনিধিদল চীনকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে আফগানিস্তানের মাটি কখনো কোনো দেশের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না। এর বিপরীতে চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কখনো হস্তক্ষেপ করবে না বরং সংকট সমাধান এবং দেশটিতে শান্তি আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। চীন পাকিস্তানের সঙ্গে চলমান তার অর্থনৈতিক করিডোরে আফগানিস্তানকেও যুক্ত করতে পারবে বলে আশা করছে। তালেবানের জন্যও এটা সুবিধাজনক হবে। তালেবান-বেইজিং এই সমীকরণ সফল হলে পাকিস্তানেরও এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বাড়বে। আফগানিস্তান পাকিস্তানের জন্য বড়সড়ো বাজারও বটে। এসব মিলিয়ে আমেরিকার দেশে ফেরা থেকে চীন ও পাকিস্তানই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে আশাবাদী অবস্থায় আছে। বালুচিস্তান থেকে কান্দাহার পর্যন্ত রেল যোগাযোগ গড়তে চায় তারা তালেবানকে সঙ্গে নিয়ে।আশপাশের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে আসন্ন আফগানিস্তান নিয়ে বেশি দুর্ভাবনায় আছে ভারত। দুই দশকে ন্যাটোর দূরবর্তী মিত্র হিসেবে দেশটিতে তারা যে বিপুল বিনিয়োগ করেছে, তার পুরোটা পানিতে ধুয়েমুছে যেতে চলছে।আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে গত দুই দশকে চার শতাধিক সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারেও বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ডজন ডজন প্রকল্প ছাড়াও, দিলারাম-জারাঞ্জ মহাসড়ক নামে ২১৮ কিমি দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক তৈরি করে দিয়েছে ভারত। কাবুলে নতুন আফগান পার্লামেন্ট ভবনটিও তৈরি করেছে তারা।ভারত তালেবানের তরফ থেকে প্রতিশোধের এত বেশি শঙ্কা করছে যে নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে আনতে প্রস্তুত হয়ে আছে।কাবুল ছাড়াও আফগানিস্তানে ভারতের চারটি কনস্যুলেট থেকে এত দিন ন্যাটো-সমর্থিত সরকারের সঙ্গে মিলে যেসব ‘কর্মসূচি’ পরিচালিত হয়েছে, তার অনেক কিছু এরই মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হেরাত ও জালালাবাদের কনস্যুলেট অপারেশন আগেই বন্ধ হয়েছে। মাজার-ই-শরিফ ও কান্দাহারের কাজকর্মও বন্ধের পথে।আফগান পরিস্থিতির অপ্রত্যাশিত মোড় পরিবর্তনে ভারতের আফগান-নীতিও আমূল বদলে গেছে। তালেবানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসার চেষ্টায় আছেন তাদের কূটনীতিকেরা।তালেবানরাও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের এই নীতির পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেও মনে করছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ইতিমধ্যে তালেবানরা ঘোষণা দিয়েছে, আফগানিস্তানের জমি ব্যবহার করে কেউ অন্য কোন রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারবে না। তালেবানদের এই নীতি অব্যাহত থাকলে, দেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর ধ্বংসাত্মক কাজ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেও মনে করেন তারা। তবে বাংলাদেশ এখনই তালেবানদের সঙ্গে কোনও কূটনৈতিক সম্পর্কে যাবে না। বাংলাদেশ বর্তমান বৈধ আফগান সরকারের সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...